পার্বত্য এলাকায় পর্যটন শিল্প বিকাশে বাধা সশস্ত্র গ্রুপ

অস্থির পাহাড় দিশেহারা মানুষ- (শেষ)

সাজেক১

আবু সালেহ আকন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:

সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো এখন পাহাড়ের বিষফোঁড়া। শুধু খুন, জখম, অপহরণ, গুম ও চাঁদাবাজির মধ্যেই তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ নেই। দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্যও তারা এখন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পর্যটকদের প্রশ্ন, এভাবে ঘুরে বেড়াতে কার ভালো লাগে? অপর দিকে এই এলাকায় যাতে পর্যটকরা না আসেন সে জন্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বছরজুড়ে চালানো হয় অপপ্রচার।

সাজেকের পর্যটন ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মৈতে লুসাই বলেন,

পর্যটন ব্যবসায় এখন ভয়াবহ ধস নেমেছে। তিনি বলেন, এই সময়ে অতীতের বছরগুলোতে মাসে ৭০-৮০ হাজার টাকার ওপরে ব্যবসায় করতেন। এখন তা নেমে এসেছে ১০ হাজারে। পর্যটকরা কেউ আর এই এলাকায় রাত কাটান না। দিনে এসে দিনেই তারা চলে যান।


আরো দেখুন:
  1. আবারও বাঘাইছড়িতে মালভর্তি ট্রাকে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আগুন

  2. রাঙামাটির সাজেকে মালভর্তি ট্রাকে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আগুন

  3. সাজেকে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা

  4. পণ্যবোঝাই ট্রাকে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আগুন দেয়ার প্রতিবাদে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

  5. রাঙামাটির সাজেকে গাড়ি চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা

  6. পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাত অচল করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে


সাজেকে গিয়ে দেখা যায়, এই এলাকায় সরকারি ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে বেসরকারি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প বিকাশে বেশ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বেশ কিছু কাঠের দোতলা বাড়ি উঠছে পর্যটকদের থাকার জন্য। স্থানীয় বাসিন্দারাই এই ঘরগুলো তৈরি করছেন।

দানিয়েল লুসাই বলেন,

এক সময় সারা বছর পর্যটকের এতটাই ভিড় লেগে থাকত যে মাঝেমধ্যে থাকার স্থান না পেয়ে তারা রাস্তার ওপর রাত কাটাতেন। স্থানীয়দের বাসা-বাড়িতেও রুম ভাড়া করে পর্যটকরা অবস্থান করতেন। এখন আর সেই অবস্থা নেই। আস্তে আস্তে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ছে এই এলাকা।

bght

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে পর্যটকবাহী একটি গাড়ি পোড়ানো হয় সাজেকের রাস্তায়। এরপরই এ এলাকার পর্যটক শিল্পে অনেকটা স্থবিরতা নেমে আসে। ওই ঘটনার পর থেকে এখনো সাজেকে যারা যান তাদের পাহারা দিয়ে নেয়া হয়। যেসব পর্যটক সাজেকের উদ্দেশে যান তারা বাঘাইহাট সেনা চৌকি এলাকায় গিয়ে জড়ো হন। পরে তাদের সেখান থেকে সেনাবাহিনীর স্কর্ট দিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাজেকের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার বিকেলে সেনা পাহারায় তাদের শহরে ফিরতে হয়। যে কেউ ইচ্ছে করলেই এখন আর সাজেকে যেতে পারেন না, আবার সেখান থেকে ফিরেও আসতে পারেন না। নিরাপত্তা নিয়ে তাদের চলতে হয়। ৩৪ কিলোমিটারের এই দুর্গম পথটুকু পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

সাজেকের পর্যটন অ্যাসোসিয়েশনের প্রশাসক সিয়াতা লুসাই বলেন,

পাহাড়ে পর্যটন শিল্প বিকাশ রোধ করতে চাচ্ছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। তারা চায় না এই এলাকায় কোনো পর্যটক আসুক। তাতে তাদের অসুবিধা হয়। যত বেশি লোকসমাগম হবে ততই তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। এ আশঙ্কায় তারা চাচ্ছে না পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটুক।

সিয়াতা লুসাই বলেন,

এলাকার পর্যটন শিল্প বিকাশে সেনাবাহিনী অনেক কাজ করেছে। সুন্দর রাস্তাঘাট করে দিয়েছে। পানির ব্যবস্থা করেছে। চিকিৎসাকেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছে। মসজিদ-উপাসনালয় গড়ে তুলেছে। এলাকার শিশুদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছে। আর এই শিল্পের কারণে এখন এই এলাকার মানুষ দুই বেলা খেয়ে-পড়ে ভালো আছেন। আগে তারা পাহাড়ে জুম চাষ করতেন, গাছ কাটতেন, শিকার করতেন। তাতে দিন চলত না। না খেয়ে থাকতে হতো। পর্যটন শিল্পের বিকাশের পরই তারা কিছু উপার্জন করছেন। পর্যটকদের সেবা দিয়ে তাদের ভালোই উপার্জন হয়। এতে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সমস্যা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন বলেন, দুর্বৃত্তরা এখনো চাঁদা দাবি করে। প্রতিটি কটেজের মালিকের কাছে সন্ত্রাসীরা এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছে।

সিয়েতা লুসাই বলেন,

এক সময় সাজেকে দিনে গড়ে ৩০০ পর্যটকবাহী গাড়ি আসত। এখন আসে ২০-২৫টা। রুইলুই জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক বোবিন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ি জনপদে পর্যটন শিল্পের যত বিকাশ ঘটবে ততই এলাকা উন্নত হবে। তিনি বলেন, রুইলুই এলাকায় পর্যটন শিল্পকেন্দ্রিক অনেক কিছ্ইু গড়ে উঠছে। তিনি যে স্কুলে চাকরি করেন সেখানে এখন ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৮৫। অথচ এখানে এক সময় কোনো স্কুল ছিল না। পর্যটন শিল্প বিকাশের সাথে সাথে এখানে আরো অনেক কিছুই গড়ে উঠেছে।

নীলাচলে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও পর্যটকদের তেমন ভিড় নেই। দু-একজন যারা এসেছেন তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পর্যটকরা এসে সব এলাকায় নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে না। এখানে রয়েছে অপহরণ আতঙ্ক। অনেকেই অপহরণের শিকার হয়েছেন ইতঃপূর্বে। কেউ কেউ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। ফলে যারা এখানে ঘুরতে আসেন তারাও কেবল শহর ও লোকালয়কেন্দ্রিক ঘোরাঘুরি করেন।

এ দিকে পাহাড়ে যাতে পর্যটকরা না যান সে কারণে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নানা অপপ্রচারও চালানো হয়। এমনকি কোনো কোনো দর্শনীয় স্থান বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যেমন স্বর্ণমন্দির গত ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে শিগগিরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। পর্যটকরা যাতে এই এলাকায় এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তা নিশ্চিত করতে তারা বদ্ধপরিকর।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: চাঁদাবাজি, পর্যটন, পাহাড়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন