পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি সংস্কার আইনে শুভঙ্করের ফাঁকি

ভূমি কমিশন আইন

ফারুক আলম :

পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ১৪টি সংশোধনীর অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। সংসদ দুই মাস পরে বসবে, তাই জরুরি বিবেচনায় এটাকে অধ্যাদেশ আকারে জারির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই আন্দোলনে উত্তাল পার্বত্য চট্টগ্রাম।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে দুটি ভোটার তালিকা হবে। একটি ভোটার তালিকা পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য যেখানে সকল বসবাসকারী ব্যক্তি অন্যান্য শর্ত সাপেক্ষ পূরণ করে ভোট দিতে পারবে। আর পার্বত্য চট্রগ্রামের জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য আরেকটি ভোটার তালিকা হবে। এই ভোটার তালিকায় শুধুমাত্র পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীরা ভোট দিতে পারবেন। পাহাড়ি অঞ্চলে যাহাদের স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে অর্থাৎ জমির মালিকানা আছে তারাই স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হবেন। সেক্ষেত্রে বাঙালিদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ভোটার হতে হলে বৈধ জমির মালিক হতে হবে। কিন্তু বাঙালিরা যাতে বৈধ সম্পত্তির মালিক হতে না পারে এ জন্য উপজাতিদের কিছু নেতা ষড়যন্ত্র করছেন। খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিক্রয় বা অন্যান্যভাবে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদকে অবহিত করে বা জেলা পরিষদের অনুমতি নেয়াকে শর্ত করে দেওয়ায় বাঙালিদের ভূমির মালিক হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।

অন্যমিডিয়া

নিরপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধের কারণে শান্তি চুক্তি বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন মন্ত্রিসভায় দেওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আরো সক্রিয় ও কার্যকর হবে। সমস্যা সমাধানে শান্তি চুক্তির অগ্রযাত্রা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এখানে একপক্ষীয় নয়, সবপক্ষের সম্মতি ও অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। একপক্ষ সব পাবে অন্যপক্ষ কিছুই পাবে না, এটি হলে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সমস্যা থেকেই যাবে। অর্থাৎ উভয়পক্ষকে কিছু ছাড় দেওয়া-নেওয়ার মন মানসিকতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষের কম বেশি হতেই পারে তা মেনে নিলেই পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামের সব জমির পাহাড়িদের নয়। তারা যেসব অঞ্চলে বাস করেন দখল শর্তের ভিত্তিতে সেসব জমির মালিকানা দাবি করে থাকেন। লিখিত মালিকানা নেই। কিন্তু বাঙালিদের যেসব জমি দেওয়া হয়েছে তা লিখিত। সেক্ষেত্রে পাহাড়িরা যদি ভূমির মালিকানা কিংবা অধিকার চায় তা গ্রহণযোগ্য দাবি হিসেবে মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে পাহাড়ি বাঙালিরা যে শঙ্কা প্রকাশ করছে তা ঠিক নয়। সেখানকার প্রতিনিধি ও প্রশাসন তো বাঙালি। সেখানে বাঙালিদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কোনো সমস্যা শক্তির মধ্য দিয়ে নয়, আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বলেন, সাবেক সেনাকর্মকর্তা ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বলতে চাই পার্বত্য-চট্রগ্রামের বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখলে বোঝার উপায় নেই সেখানে গুরুত্বর সমস্যা রয়েছে কিন্তু সেখানে মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। এখনো পার্বত্য চট্রগ্রামের কিছু উপজাতি নেতা মনে করেন পাহাড়ি অঞ্চলে যত ভূমি, জমি আছে এর একমাত্র মালিক পাহাড়িরাই। সেখানে বাংলাদেশ সরকার কিংবা বাঙালিরা ভূমির মালিক থাকতে পারবে না। এসব সমস্যা থাকার পরেও আওয়ামী লীগ সরকার ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের জন্য ক্যাবিনেটে অনুমোদন দিয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পাহাড়ের সব জমির মালিক উপজাতিরা নয়। বাঙালি জনগণও পার্বত্যাঞ্চলের ভূমির মালিক। এই সমস্যা দূর করতে সরকার ভূমি কমিশন আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও এর পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। ভূমি কমিশন আইন সংস্করণে ১৯৭০ সালে যেসব বাঙালি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়েছিল তাদেরকে সেখান থেকে চলে আসতে হবে। উপজাতিরা প্রকাশ্যে এটি বলতে পারছেন না, এই জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যাতে বাঙালিরা বাধ্য হয়ে পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে চলে আসে। ভূমি সংস্কার আইনের মাধ্যমে উপজাতিরা সেটিই অর্জন করে নিলো।

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ১৯৮৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলের এসব দেশদ্রোহীরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলো পুরো বাংলাদেশ দু’টি ভাগে ভাগ করার। এক ভাগের নাম বাংলাদেশ যার রাজধানী ঢাকা। আর এক ভাগের নাম হবে জুম্মল্যান্ড যার রাজধানী রাঙাগামাটি। এ দুটি অংশ মিলে একটি ফেডারেল সরকার হবে। তখন আমরা রাজি হইনি। কিন্তু বর্তমান এই ভূমি আইন বাস্তবায়নের ফলে দেশদ্রোহীদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

পার্বত্য চট্রগ্রাম ভূমি সংস্কার আইনে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরপরেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বুঝে হোক না বুঝে হোক এই শুভঙ্করের ফাঁকিতে পা দিয়েছেন। ভূমি কমিশন আইন সংস্করণের মধ্য দিয়ে উপজাতিরা একের পর এক রায় দেবে- এই জমির মালিক বাঙালি নয়, এই জমির মালিক বাঙালি নয়, এই জমির মালিক বাঙালি নয়। বাঙালিরা এভাবে যখন ভূমির মালিকানা হারাবে তখন ভোটের অধিকারও হারাবে। আমরা ৪০ বছর আগের পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতে ফিরে যাব। ১৯৭৫ সালে উপজাতি প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আবারও সেই যুদ্ধ শুরু হবে। বাঙালিরা পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে চলে আসার পর এ অঞ্চল সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

ক্যাবিনেটে পার্বত্য চট্রগ্রাম ভূমি সংস্কার আইনের বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে রাঙামাটি মহিলা সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু এমপি বলেন, এটাতো একটি অডিনেন্স হয়েছে মাত্র। এটি নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশ্লেষণ হবে। কারো ক্ষতি হবে সেই সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। আর পার্বত্য চট্রগ্রাম কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। এখানে কেউ কারো জায়গা দখল করেনি। সরকারের বন্দবস্তি নিয়ে বাঙালি ও পাহাড়ি সবাই একত্রে বসবাস করছে। একজন পাহাড়ি যদি বাঙালির জমি দখল করে তাহলে আমি সেই পাহাড়ির পক্ষে যাব না। আবার একজন বাঙালি যদি পাহাড়ির জমি দখল করে তখনও আমি বাঙালির পক্ষে যাব না। পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম অংশ, এখানে সকলের বসবাস করার অধিকার রয়েছে।

পার্বত্য চট্রগ্রাম বাংলাদেশের আলাদা অংশ নয় এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সেই ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট দৃষ্টি রয়েছে। পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হবার আগ মুহূর্তে অনেকে বলেছেন এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাঙালিদের চলে যেতে হবে। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- পার্বত্য চট্রগাম থেকে একজন বাঙালিকেও সরে যেতে হবে না।

ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, আমরা যারা পাহাড়ে বসবাস করছি কখনো সরকারের কাছে দাবি করিনি এই পার্বত্য অঞ্চলে শুধু পাহাড়ি এমপি, মন্ত্রী ও চেয়ারম্যান হবে কেন? আমরা পাহাড়িদের সমস্ত নেতৃত্ব মেনে নিয়েই এখানে বসবাস করতে চাই। তাদের সমস্ত নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার পরেও যদি বাঙালিদের অস্তিত্ব সংকটে পরে তখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকার কখনো কারো অধিকার বঞ্চিত করবে না। বর্তমান সরকার অধিকার বঞ্চিতদের পক্ষেই থাকে। সেই বিশ্বাস রেখে আমি মনে করি বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্রগ্রাম নিয়ে এমন কোনো কাজ করবেন না যেখানে বাঙালিদের অধিকার বঞ্চিত হয়।

– সূত্র: আমাদের সময় ডটকম

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন