পর্যটন সম্ভাবনায় বাধা সন্ত্রাস: সাজেক-রিসাংয়ে বদলে গেছে অর্থনীতি-জীবনযাত্রা

fec-image
পাহাড়ে অশান্তির আগুন-৮

সাজেক ২

ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে :

পারিবারিক ঐতিহ্য মেনেই জুম চাষ করতেন জুমিতা চাকমা। যা দিয়ে পরিবার নিয়ে তিন বেলা কোনমতে খেয়ে-পরে থাকতেন। এখন সেই জুমিতারই মাসিক আয় ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে উঠা সাজেক পর্যটন স্পটই বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। সাজেকে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হওয়ার পরপরই জুম চাষ বাদ দিয়ে কাঠের তৈরি ছোট একটি রিসোর্ট দিয়েই ঘুরে গেছে তার ভাগ্য চাকা।

বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউপিডিএফের এক সময়ের সক্রিয় কর্মী (নিরাপত্তার জন্য নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন) অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে মোটরসাইকেল চালানো শুরু করেছেন। রিসাং ঝর্ণাতে পর্যটকদের আনা নেয়া করেই দিনে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করছেন। কুলসেন ত্রিপুরাও একই কাজ করে খুব ভালোভাবেই জীবন গুছিয়ে নিচ্ছেন।

জুমিতা চাকমা, কুলসেন ত্রিপুরা কিংবা সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে ফিরে আসা ওই যুবক শুধু এই তিন জনেরই নয়, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালী ও রিসাং ঝর্ণা বদলে দিয়েছে হাজারো মানুষের জীবন। জুম চাষী থেকে শুরু করে বেকার যুবক অনেকেই কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছেন পর্যটনকে কেন্দ্র করে। এই অঞ্চলেই সাজেক-রিসাং ঝর্ণার মতো আরও অসংখ্য স্পট রয়েছে যেগুলোকে পর্যটন স্পটে পরিণত করতে পারলে বদলে যেতে পারে পাহাড়ের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা। ঝর্ণায় গা ভিজিয়ে নিতে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে মেঘ ছুয়ে দেখতে পর্যটকরাও ভিড় করবেন দলে দলে। সম্ভাবনাময় এই পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সরকারও।

কিন্তু এ শিল্প বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। পর্যটন শিল্প বিকাশ না করতে এবং পর্যটকদের আগমন ঠেকাতে প্রায় হামলা, চুরি, ছিনতাই, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করছে তারা। এতে করে পর্যটনে সমৃদ্ধ পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হুমকীর মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টারা। একইসাথে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার। শুধু পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন বিকশিত করতে পারলে প্রতি বছর সরকার ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

মেঘের রাজ্যে সাজেক: খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৬৯ কিলোমিটার দূরে রাঙামাটি জেলার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত সাজেক। নীল আকাশের নীচে হাত দিয়ে মেঘ ছুয়ে দেখতে এবং বিস্তীর্ণ পর্বতরাজী দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করেন সেখানে। পাহাড়ের বুক চিরে আঁকা-বাঁকা সাজেকের পথই মন ভরিয়ে দেয় তাদের। সেনাবাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় গড়ে উঠা সাজের পাশেই রুইলুই পাড়ায় অবস্থিত হ্যারিজন গার্ডেন, ছায়াবীথি, রংধনু ব্রীজ, পাথরের বাগান সবই যেন দাগ কেটে দেয় পর্যটকদের মনে। আর তাই দিনে দিনে এই পর্যটন কেন্দ্রটি সবার কাছে হয়ে উঠছে পছন্দের শীর্ষে।

পর্যটনের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর পর্যটকদের আগমনই আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের কাছে। কিছুদিন আগেও এই পাহাড়টি আর দশটি পাহাড়ের মতোই সাধারণ পাহাড় হিসেবে পরিচিত ছিল। আশপাশে বিচ্ছিন্নভাবে ঝুপড়ি ঘরে বাস করে জুম চাষের মাধ্যমে জীবন ধারণ করতেন স্থানীয়রা। সেই পাহাড়েই এখন সোনার ফসল তুলছেন অনেকেই।

শুভ চাকমা নামে এক স্থানীয় উপজাতি জানায়, সেনাবাহিনী সাজেক গড়ে তোলার পর থেকেই জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়ে গেছে তাদের। নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি ছেলে-মেয়ারও এখন স্কুল যাচ্ছেন। অথচ ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে পড়বে তা তারা কখনো ভাবেননি। সরকারের যুগোপযোগী একটি পদক্ষেপে আমাদের শিশুরা ভবিষ্যতে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে তা ভাবতেই ভালো লাগে।

সাজেক পর্যটন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনিত্য ত্রিপুরা বলেন, আমাদের সমিতির সদস্য ১৬জন। তবে এখানে ৩৫-৩৬টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এতে ৩-৪ হাজার মানুষ একত্রে বাস করতে পারে। আমার দু’টি হোটেল রয়েছে। তা থেকে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় হয়। আগে জঙ্গলে জুম চাষ করতাম, এখন আর জুম চাষ করতে হয় না। তিনি জানান, একটি গ্রুপ পাহাড়ে পর্যটনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তবে এখন আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কোন চাপ দিচ্ছে না। কিন্তু সেনাবাহিনীর উপস্থিতি না থাকলে তারা চাঁদা চাইতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

৩৭ নং সাজেক ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার শান্তি ত্রিপুরা বলেন, সাজেকে পর্যটন স্পট হওয়ার আগে আমরা গামছা পরে থাকতাম। পর্যটকরা এসে আমাদের প্যান্ট-শার্ট পরতে শিখিয়েছে, সামাজিকীকরণ করেছে। আগে এখানে জুম চাষ করে কোন মতে জীবনধারণ করতে হতো। এখন প্রতিটি পরিবার রিসোর্ট বানিয়ে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা আয় করছে। ছেলে মেয়েরা স্কুল যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ওই এলাকার ১২শ’ মানুষের মধ্যে ৬শ’ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয়েছে সাজেককে কেন্দ্র করে। সাজেকের আশপাশে থাকা কংলাক, শেলদাই, তুইচুই, ব্যাটলিং, সিকাম তৈশা ঝর্ণা, দুই ছড়া ঝর্ণার মতো স্পটগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের পর্যটন মডেল হিসেবে ওই এলাকাকে গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। এজন্য সেনাবাহিনী ও সরকারের সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান।

রিসাং ঝর্ণা:

খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙ্গা উপজেলাতে অবস্থিত রিসাং ঝর্ণা। খাগড়াছড়ি ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ হলো দৃষ্টি নন্দন এই ঝর্ণা। মূল রাস্তা থেকে নেমে উচু-নিচু পার্শ্ব রাস্ত দিয়ে একটু ভেতরে গেলেই কানে আসে ঝর্ণার পানির শব্দ। চোখ এড়ায়না পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যও। হাজার ফুট নীচের উপত্যকায় দৃষ্টি পড়লে অপূর্ব মুগ্ধতায় ভরে যায় যে কারো মন।

রোমাঞ্চকর শিহরণ জাগানো পাশাপাশি দুটি ঝর্ণাতে প্রতিদিন পর্যটকদের ভিড় থাকে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এই ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে শতাধিক স্থানীয় অধিবাসীর কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে। কেউবা মোটরসাইকেলে পর্যটক পরিবহন করে কেউবা নানাধরনের পণ্যের দোকান নিয়ে বসেছেন। কুলসেন ত্রিপুরা বলেন, আগে আমরা বেকার ছিলাম। অনেকেই অনেক অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।

কিন্তু রিসাং ঝর্ণায় পর্যটক আসা শুরু হলে এটাকে কেন্দ্র করেই জীবনযাত্রা বদলে গেছে। কাজ করেই এখন অনেক টাকা আয় করতে পারছি।

স্থানীয়রা বলছেন, সাজেক ও রিসাং ঝর্ণা পর্যটন স্পট শুধু স্থানীয় পর্যটনের উন্নতি ঘটায়নি বরং পুরো খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন সেক্টরকে বদলে দিয়েছে। সাজেক ভ্রমণের আগে বা পরে দূর দূরান্তের দর্শনার্থীরা দেখে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গপথ, হাজাছড়া ঝর্ণা, আলুটিলা তারেং, পানছড়ির শান্তিপুর অরণ্য কুটির বৌদ্ধ বিহার, শান্তিপুর রাবার ড্যাম, মানিকছড়ির রাজবাড়ি, রামগড়ের সীমান্তবর্তী চা-বাগান, মাইসছড়ির দেবতাপুকুর, মহালছড়ির এপিবিএন লেক, জেলা সদরের পানখাইয়াপাড়ার নিউজিল্যান্ড পার্ক ও জেলাপরিষদের হর্টিকালচার পার্ক ইত্যাদি।

চাঁন্দের গাড়ী চালক মো: আ: শুক্কুর জানান, সাজেকের ভাড়া এখন প্রতিনিয়ত হচ্ছে। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে কমপক্ষে শতাধিক গাড়ি গাড়ী সাজেক যাচ্ছে এ ছাড়াও প্রতিদিন ২০-৫০ গাড়ীতে ৩০০- ৫০০ পর্যটক আসা-যাওয়া করছে। সিজনে এটা অনেক বৃদ্ধি পায়। এই সাজেক চাঁন্দের গাড়ী মালিক ও চালকদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এই সাজেকই জমজমাট রেখেছে খাগড়াছড়ির আবাসিক হোটেল, খাবার হোটেল ও টেক্সটাইল দোকানগুলোর বাণিজ্যকে।

খাগড়াছড়ি জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম শফি বলেন, সাজেক, রিসাং, আলুটিলা পুরো খাগড়াছড়ির অর্থনীতি বদলে দিয়েছে। তবে এই এলাকায় এখনো অসংখ্য পর্যটন স্পট রয়েছে যেগুলো কাজে লাগাতে পারলে খাগড়াছড়ি পুরো পর্যটন শিল্পের মডেল হতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয়দের কর্মসংস্থান এবং সরকারের বিপুল রাজস্ব আয় হতে পারে। তিনি বলেন, আলুটিলা ইকোট্যুরিজম পর্যটনসহ বিভিন্নস্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আলুটিলা থেকে কোন বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ছাড়াই সেখানে ইকোট্যুরিজম তৈরী করা যাবে। কিন্তু একটি মহল এ পর্যটনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

পর্যটন বিরোধী প্রচারণা:

সম্ভাবনাময় পর্যটন খাগড়াছড়ির অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনলেও এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য কাজ করছে সন্ত্রাসীরা। পর্যটকরা যাতে ওই এলাকায় যেতে না পারে সেজন্য চালানো হচ্ছে পর্যটন বিরোধী প্রচারণা। ব্যানার-পোস্টার টানিয়ে এবং লিফলেট বিতরণ করে খাগড়াছড়িতে না যেতে পর্যটকদের বলা হচ্ছে।

এসব লিফলেটে বেশকিছু মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে ‘পর্যটন তুলে নাও- নিতে হবে’ এই শ্লোগান প্রচার করা হচ্ছে। শুধু এখানেই থেমে থাকেনি ভীতি সৃষ্টির জন্য পর্যটকদের অপহরণ, হুমকী প্রদান, হামলা, চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। গাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিও করেছে সন্ত্রাসীরা। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, পর্যটন কেন্দ্রে মানুষের আগমনে সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারে বাধার সৃষ্টি হওয়ায় পার্বত্য এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিরুদ্ধে পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো নানাভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করছে।

সম্প্রতি পর্যটক দম্পতির গাড়ী পোড়ানোর ঘটনায় পর্যটকরা ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। বিশেষ করে রিজার্ভ ফরেষ্টের দু’পাশে অবৈধ বসতি ও স্থাপনা গড়ে ওঠায় নিরাপত্তা নিয়ে কানা-ঘুষা চলছে সব মহলে। এইসব অবৈধ বসতি ও স্থাপনা তুলে রাস্তার দু’ধার যদি পরিষ্কার রাখা যায় তাহলে নিরাপত্তা বাহিনীও বহু দূর থেকে নজর রাখতে পারবেন। স্থানীয়রা বলেন, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন। তারা কঠোর হস্তে সন্ত্রাসীদের দমন করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।

সাজেক এলাকার পর্যটন এসোসিয়েশনের প্রশাসক সিয়াতা লুসাই বলেন, এখানকার পর্যটন শিল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। তারা চাঁদা দাবি করে, এলাকায় ভয়ভীতি দেখায়। ২০১৪ সালে একটি গাড়ি পুড়িয়ে এলাকায় ভীতি সৃষ্টি করেছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রহরায় সাজেকে পর্যটকদের ভ্রমণ করানো হয়।

পাহাড়ে পর্যটনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা দীপঙ্কর তালুকদার বলেন, বান্দরবানে পর্যটন ভালো ফ্লারিশ হলেও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে তেমন হয়নি। জেএসএস-ইউপিডিএফ পর্যটকদের নানভাবে বাধা দিচ্ছে। বালুখালী ঝর্ণায় যেতে হলে তাদের চাঁদা দিতে হয়। না দিলে সবকিছু কেড়ে নেয়। তিনি বলেন, যদি পর্যটনকে ভালোভাবে বিকশিত করা যায়। তাহলে আমরা পাহাড়ের পর্যটন থেকে সরকারের জাতীয় রাজস্ব খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন