নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ে অপ্রতিরোধ্য আনোয়ার বাহিনী

বাইশারী প্রতিনিধি:

আতংকে তিন ইউনিয়নের দুই লাখ জনসাধারণ

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি ইউনিয়ন ও কক্সবাজারের রামুর ঈদগড়, গর্জনিয়া আনোয়ার বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে।

ইতিমধ্যে সন্ত্রাসীদের মাঝে কয়েকবার গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। এতে হতাহতও হয়েছে। গত দুই বছরে তিন ইউনিয়ন থেকে শতাধিক বাসিন্দাকে অপহরণের পাশাপাশি সন্ত্রাসীরা বসতবাড়ি ও সড়ক ডাকাতি করেছে অর্ধশতাধিক। কোটি টাকার অধিক আদায় করেছে মুক্তিপণ। ফলে এই অঞ্চলের দুই লাখ বাসিন্দা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

এসবের নেপথ্যে রয়েছে আনোয়ার বাহিনীর প্রধান আনোয়ার ওরফে আনাইয়্যা ডাকাত। প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন, গুম, চাঁদাবাজি, মোবাইল ফোনে হুমকি, তার নিত্য দিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তার সেকেন্ড-ইন কমান্ড হল রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের উত্তর বড়বিল গ্রামের মৃত নুরুল হাকিমের পুত্র হামিদ ডাকাত। এ অঞ্চলের আতঙ্ক কারা?

প্রতিবেদকের মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান এবং স্থানীয়দের ভাষ্য আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আনোয়ার বাহিনীর প্রধান আনোয়ার ওরফে আনাইয়্যা।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ির বাঁকখালী নদীর মুখ, গর্জনিয়ার বড়বিল, মাঝিরকাটা, কচ্ছপিয়ার ফাক্রিকাটা, ঈদগড়-বাইশারি সড়কের ব্যাঙডেবা, করলিয়ামুড়া, চাইল্যাতলী, ঈদগাও-ঈদগড় সড়কের পানের ছড়া, ডালার মুখ, হিমছড়ি, ছনখোলা, অর্জন বাগান ও ইসলামাবাদের গজালিয়াসহ আশপাশ এলাকাজুড়ে আনোয়ার বাহিনীর ত্রাসের রাজত্ব চলে।

আনোয়ার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা অন্তত ৩০-৩৫জন। তাঁরা সবাই অস্ত্র চালাতে পারেন। সন্ত্রাসী আনোয়ারের তথ্যজাল শক্তিশালী হওয়ায়, তার কাছে জনপ্রতিনিধি এমনকি পাত্তা পায় না পুলিশ কর্মকর্তাও।

সাম্প্রতিক সময়ে খোদ বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম ও বাইশারী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) আবু মুসাকে মুঠোফোনে হত্যার হুমকি দেয় আনোয়ার। এ বিষয়ে তারা দুজন নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেছেন।

এদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় বিভিন্ন সময় ৯জন দুর্ধষ সন্ত্রাসীকে আটক করতে সক্ষম হয়। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আনোয়ারের নেতৃত্বেই এসব অপকর্ম চালাতেন বলে জানায়।

বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, পুলিশ-বিজিবির যৌথ অভিযানে আনোয়ার বাহিনীর একাধিক সদস্য এবং সাঙ্গপাঙ্গরা ধরা পড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখে ধুলো দিয়ে গা ঢাকা দেওয়ায় আনোয়ার সর্দার স্থানীয় জনজীবনকে উৎকণ্ঠায় রেখেছে। আনোয়ার গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে না’।

গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বড়বিলের দুই সহোদর হত্যা ও নারাইম্যাঝিরিতে দুই ব্যক্তি খুনের সঙ্গে ডাকাত আনোয়ারও জড়িত ছিল। তার বাহিনীর সদস্যরা ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের লাগাম টেনে ধরা উচিত। পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তার জন্যে গর্জনিয়ার মরিচ্যাচর এলাকায় একটি পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।’

বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য আনোয়ার সাদেক বলেন, ‘আনাইয়্যা ডাকাতের ভয়ে ঈদগড়-বাইশারী সড়কে সন্ধ্যার পর যানবাহান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ইউনিয়ন জুড়ে নেমে আসে অঘোষিত ‘কার্ফু’। বাইশারী করলিয়ামুড়ার ঘোনারপাড়ায় নিজ বাড়ির পাশেই রয়েছে আনোয়ার বাহিনীর আন্তানা। সেখানে অস্ত্রধারীদের নিত্য আনাগুনো হলেও পুলিশ অনেকটা নিরুপায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ত্রাসী আনোয়ারের বাবার নাম মৃত আবদু সোবহান, মাতার নাম ছুরত জামান প্রকাশ ছুরুনী ইউনিয়নের করলিয়ামুরা লম্বাবিল ঘোনার পাড়া গ্রামে তার বসবাস। আনোয়ার বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত ডাকাত ও নিরহ জনসাধারণসহ খুন হয়েছে চারজন।

ডাকাত আনোয়ারের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি ডাকাতিসহ ডজন ডজন মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, একের পর এক দলের সদস্যরা ধরা পড়লেও তাদের তৎপরতা কমানো যাচ্ছে না। রাত নামলেই রামুর গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি এলাকায় আনাইয়্যা বাহিনীর তৎপরতা আরম্ভ হয়। ডাকাত আতঙ্কে রাতের বেলায় অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র রাত্রিযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরই মধ্যে আনাইয়্যার ভয়ে তার গ্রামের গোলজার বেগম ও মো.আবুর পরিবারসহ একাধিক পরিবার নিজেদের কর্ম কিংবা বিশেষ প্রয়োজন দেখিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত আনাইয়্যা লম্বাবিল, ঘোনাপাড়া, চাইল্যাতলী ও আলীক্ষ্যং সড়কে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে থাকে। তার ভয়ে স্থানীয় আশপাশের লোকজন মুখ খুলতে ভয় পায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা জানিয়েছেন, ডাকাত আনাইয়্যার বিরুদ্ধে মুখ খোললেই তাদেরকে সরাসরি হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ডাকাত আনাইয়্যার হাতে এ পর্যন্ত বাইশারি, দোছড়ি, ঈদগড়, গর্জনিয়া ও বাইশারি-ঈদগড়-ঈদগাঁও সড়কে পঞ্চাশ জনের অধিক অপহরণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে তার হাতে খুন হয়েছেন ৪ জন। এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী ডাকাত আনাইয়্যা এখন বেপরোয়া। প্রকাশ্যে দিবালোকে বেআইনি অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা ও তার হুঙ্কারে সাধারণ জনগণ আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছে।

এদিকে পুলিশের একাধিক সূত্র বলেছে, বাইশারি এলাকাটির একদিকে মিয়ানমার এবং তিনদিকে অন্য থানা এলাকা হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়েও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশের তাড়া খেয়ে তারা অন্য থানা এলাকায় চলে যায়। এ অবস্থায় সুফল পেতে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে।

অপরদিকে সর্বশেষ গত ১ আগস্ট দিনেদুপুরে আনোয়ার বাহিনী সদস্যরা বাইশারীর স্টার রাবার বাগানের ম্যানেজার আরিফ উল্লাহকে অপহরণের দুইদিন পর তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপনের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়।

এছাড়া ৩০ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড দক্ষিণ নজুমাতবরপাড়া গ্রামে ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা ঘটে। অপহরণের শিকার হওয়া দুই সহোদর হলেন-আমির হোসেনের ছেলে শহিদুল্লাহ (১৩) ও মোঃ রিদুয়ান (১৬)। পরে তাদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এর আগে ১৭ এপ্রিল দোছড়ি ইউনিয়নের লংগদুর মুখ থেকে সাইফুল ইসলাম অপহৃত হন। সেও একই কায়দায় মুক্তি পান। গত ২০ জানুয়ারি লেদুখাল এলাকা থেকে আবদুর রহিম, আবু ছৈয়দ, আবদুল আজিজ ও শাহ আলম অপহৃত হন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সনের ১০ ডিসেম্বর ঈদগড়-ঈদগাঁও সড়কের পানেরছড়া ঢালা থেকে সর্ব প্রথম অপহৃত হয় ঈদগড় ইউনিয়নের মৃত আলকাছ আহম্মদের ছেলে বনি আমিন ও সিকদার পাড়া এলাকার আবু বক্কর সিকদারের ছেলে আকবর হোসেন। ৭২ ঘন্টা পর ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা মুক্তি পায়। ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট লম্বাবিল এলাকা থেকে হাফেজ রশিদ উল্লাহ, ২০১৫ সনের ২২ এপ্রিল ঈদগড় সড়কের হিমছড়ি ঢালাস্থ সাততারা ঘোনা নামক স্থান হতে অপহরণের শিকার হন ঈদগড় বড়বিল এলাকার কাশেম আলীর ছেলে সিএনজি চালক সাইফুল ইসলাম (২২), বাইশারির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ফরিদুল আলম ও ঈদগড় বড়বিল এলাকার মোঃ হোছনের ছেলে নুরুল ইসলাম। ৪৮ ঘন্টা পর মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
২০১৬ সনের ৪ ফেব্রুয়ারি বাইশারি ইউনিয়নের লেদুরমুখ থেকে তামাক চাষী ছালেহ আহামদ ও রাজিব, ৩০ এপ্রিল বাইশারি ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি চাইল্যাতলী থেকে মো. শাহজালাল, ৫ মে ঈদগড় বাজার থেকে যাত্রী নিয়ে রাঙ্গাঝিরি যাওয়ার পথে মিজানুর রহমান ও মে মাসের প্রথম তারিখে দোছড়ি ইউনিয়নের ওয়াচ্ছাখালি থেকে বুলবুল আক্তার (১১) অপহৃত হন। ২৫জুন ঈদগাঁও হতে ঈদগড় যাওয়ার পথে কক্সবাজার সদরের হিমছড়ি নামক স্থান হতে অপহরণের শিকার হয় ঈদগড় ছগিরাকাটা এলাকার জালাল আহাম্মদের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (২৩), পুর্ব রাজঘাট এলাকার রশিদ আহাম্মদের ছেলে মাওলানা মনিরুল ইসলাম খোকন (৩৩), গিলাতলি এলাকার মোঃ কালু। তাদেরকে ৩ দিন পর মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়।

১২ আগস্ট বাইশারি ইউনিয়নের রাঙ্গাঝিরি থেকে মিজানুর রহমান, একই মাসে দোছড়ি ইউনিয়নে লংগদু থেকে ফরিদুল আলম, মো. হুমায়ুন কবির, বড়ইচর এলাকা থেকে জালাল উদ্দিন, আবদুল কাদের অপহরণের শিকার হয়েছে। ২৪ আগস্ট বাইশারি-ঈদগড় ঈদগাঁও সড়কের ধুমছাকাঠা স্থান থেকে মিনি বাস থামিয়ে ডাকাতির পর মৌলানা হাবিবুর রহমান, বাইশারির যুবলীগনেতা নুরুল কবির রাশেদ, ব্যবসায়ি নেজাম উদ্দীনকে অপহরণ করে ৩০ ঘন্টা পর ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১১ অক্টোবর বাইশারি ইউনিয়নের ব্যাঙডেবা এলাকা থেকে মো. ইউনুছ, মো. করিম, মো. আবু বক্করকে অপহরণ করা হয়। পরে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়। ২৩ অক্টোবর পিএইচপি রাবার বাগানের ৮ নম্বর বল্ক থেকে আজিজুল হক, নুরুল আলম, আবদু শুক্কুর অপহৃত হন। ২১ নভেম্বর ঘুমধুম জামতলী পাড়া থেকে মো. হোছন, নুরুল আজিম অপহৃতদের কবলে পড়েন।

২০১৭ সনের ২১ নভেম্বর বাকখালী মৌজার ছাগলখাইয়া থেকে নুরুল আজিম, মো: হোছন, ও কাগজিখোলা থেকে ছৈয়দ বাবর (৩০), ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়ন ও রামু উপজেলার ঈদগড় সড়কের সীমানায় গজালিয়া এলাকায় গত বছরের ২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার রাত ১০ টার দিকে ঈদগড় যাওয়ার পথে সিএনজি ও ১টি মোটরসাইকেল ব্যারিকেড দিয়ে ৮-১০ জন সশস্ত্র মুখোশ ধারী সন্ত্রাসী যাত্রীদের কাছ থেকে মারধর করে নগদ ৩০-৪০হাজার টাকা ও মোবাইল কেড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় রামু উপজেলা ঈদগড় ইউনিয়নের বাইতুশরফ এলাকার নুরুল আমিন ও হেলাল উদ্দিন নামের দুজনকে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। ৭২ ঘন্টা পর তারা নিজেদের বুদ্ধি মত্তায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

সর্বশেষ গত ১ আগস্ট ২০১৮ দিনে দুপুরে রাবার বাগান ম্যানেজার আরিফ উল্লাহকে অপহরণের পর ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে তিন লাখ টাকা মুক্তিপন নিয়ে ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। তাছাড়া গত ৬ আগস্ট সকাল সাড়ে ছয়টার সময় আনোয়ার বাহিনীর সদস্যরা বাইশারী-আলীক্ষ্যং সড়কে মাল্টাবাগান নামক স্থানে অর্ধশতাধিক শ্রমিককে জড়ো করে প্রকাশ্যে হুমকি প্রদর্শণ ও বাগানে কাজ কর্ম করতে নিষেধ করে দেয়। এসময় আনোয়ার বাহিনীর প্রধান আনাইয়া শ্রমিকদের সামনে হুংকার দিয়ে বলে তার কথা যদি কেউ না শুনে তাহলে খুন, গুমসহ অপহরণ করা হবে। যার ফলে হাজার হাজার শ্রমিকসহ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা আতংকে রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন