নাইক্ষ্যংছড়িতে টানা ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, শতাধিক গ্রাম প্লাবিত

বাইশারী প্রতিনিধি:

তিন দিন ধরে টানা বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি জনপদগুলোতে। বিশেষ করে, উপজেলার শতাধিক গ্রামে হাজারেরও অধিক পরিবার এখন পাহাড় ধস আমলে নিয়ে সকল দুর্ঘটনা এড়াতে তৎপর হয়েছেন নানাভাবে।

গেল সপ্তাহে মাসিক সমন্বয় সভায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম সরওয়ার কামাল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারমানসহ পরিষদ বর্গকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন ইতিমধ্যেই।

সরেজমিন ঘুরে আরও জানা যায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাটি মূলত পাহাড়ি জনপদ। এখানকার শতভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আর ৪০ শতাংশ বাঙ্গালী বসবাস করে পাহাড়ের চূড়ায় বা ঢালুতে। প্রায় লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ উপজেলায় সে হিসেবে অধিকাংশ মানুষের বাস পাহাড়ে। এ কারণে এ আশঙ্কার বিষয়টি এখন নাইক্ষ্যংছড়ির আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ পরিচালকের পক্ষে হাফিজুর রহমান জানান, গত ১০ জুন বিকেল ৪টা থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা থাকায় বর্তমানে সাগরে ৩ নম্বর স্থানীয় সর্তক সংকেত ঘোষণা করা হয়। আর ভারি বর্ষণ হলে তো বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতেই পারে। আর এরই মধ্যে পাহাড় ধস একটি।

একাধিক সচেতন মহল জানান, উপজেলার শতাধিক গ্রামে শতশত পরিবার পাহাড়ের ঢালু বা চূড়ায় বসবাস করছে। এসবের মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের আদর্শ গ্রাম, মসজিদ ঘোনা, বিছামারা, জারুলিয়াছড়ি, সোনাইছড়ি, ঘুমধুম ফাত্রাঝিরি, বৈদ্যছড়া, তুমব্রু বাইশপাড়ি, লেবুছড়ি, পাইনছড়ি, টাংগ্ররা, ছরই মুরু পাড়া, ভাইসাং চাক পাড়া, বাইশারীর সাপমারা ঝিরি, দশতলা পাহাড়, ছাগল খাইয়া, হরিণখাইয়া, ডলুর ঝিরি, চিকনছড়ি, রাঙ্গাঝিরি, কাগজিখোলা, ইদগড় হেডম্যান পাড়া, উপর চাক পাড়া, তোফান আলী পাড়া, করলিয়া মুরা, হলদিয়া শিয়া ও লম্বাবিল সহ অসংখ্য গ্রাম রয়েছে পাহাড় অধ্যুষিত। এসব এলাকায় এমনিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকে সব সময়।
আর এর উপর পাহাড় কেটে বিরান ভূমিতে পরিণত হওয়া এ সব গ্রামে ঝুঁকি বেড়ে তিন গুণে দাঁড়িয়েছে।

অপরদিকে টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণে পাঁচ ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম প্লাবিত। এরই মধ্যে বাইশারী ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশারী, দক্ষিণ বাইশারী, করলিয়ামুরা, মধ্যম বাইশারী, নারিচবুনিয়া, ধৈয়ার বাপের পাড়া, মধ্যম চাকপাড়াসহ অনেক গ্রাম।

ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনার পাড়া, তুমব্রু, দক্ষিণ কুল, বাইশপাড়ি, ফাত্রাঝিরি, গর্জনবুনিয়া। দোছড়ি ইউনিয়নের বাকখালী, ছাগলখাইয়া, কালুরঘাট, দোছড়ি সদর। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নে ছেরার কুল, চাকঢালা, হেডম্যান পাড়া, ফুলতুলি, আশাদতলী, জারুলিয়া ঝিরি। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মারিগ্যা পাড়া, লামার পাড়া।

এছাড়া টানা বর্ষণে বাইশারী-ঈদগড়-ঈদগাও সড়কের পালপাড়া, ভুমুরিয়া ঘোনা, ছনখোলা নামক স্থানে পাহাড়ী ঢলের পানিতে ডুবে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাইশারী-গর্জনিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের গয়াল মারা, থিমছড়ি এলাকায় পাহাড়ী ঢলের পানিতে ডুবে যাওয়ায় গাড়ি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের মহিষকুম, কাওয়ারকূপ এলাকায় পানি বৃদ্ধির ফলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে জনসাধারণের চলাচলে চরম দুর্ভোগ।

বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আলম কোম্পানী জানান, বাইশারীতে বিভিন্ন সময় পাহাড় ধসে মারা গেছে বেশ ক’জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে রাঙ্গাঝিরি অন্যতম। বর্তমানে তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কার কথা চিন্তা করে তিনি তার পরিষদ বর্গকে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে বলে নিয়েছেন ইতিমধ্যেই।

তাছাড়া বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের লোকজনকে দক্ষিণ বাইশারী পিএইচপি রাবার বাগানের ধুম ঘর এবং অন্যান্য গ্রামের লোকজনদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য জানানো হয়েছে। কেননা এটা চলতি মৌসুমের প্রধান এবং অন্যতম কাজ। উপজেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে ফোন করেছেন তাকে। তাই তিনি এটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষভাবে। এভাবে পুরো উপজেলাতে প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বার্হী অফিসার এসএম সরওয়ার কামাল জানান, ভারি বর্ষণের খবর তিনি শুনেছেন। এ কারণে নানা প্রস্তুতিও নিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের বিষয়ে কী করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে তিনি কাজ শুরু করতে চান সকলকে নিয়ে। আর তা আজকালের মধ্যে শুরু করবেন তিনি। বিশেষ করে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে।

এদিকে স্থানীয়রা জানান, নাই্ক্ষ্যংছড়িতে পাহাড় ধস হওয়ার কারণ একাধিক। তম্মধ্যে পাহাড় কেটে নানাভাবে মাটি সরানো এলাকা গুলোর আশ পাশের জনবসতিতে পাহাড় ধস হওয়ার আশঙ্কা বেশি দেখা দিয়েছে। বড় বড় পাহাড় কেটে এ উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে মাটি ভরাটের কাছ চলছে জোরেশোরে। যা চলে আসছে কয়েক মাস ধরে। আর এ সবে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। যাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। তাদের দাবী প্রশাসনকে ম্যানেজের মাধ্যমে আমরা এসব করে থাকি।

তারা আরও জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের নিরবতার সুযোগে পাহাড় খেকোরা এ অরাজকতা করেছে প্রকাশ্যে এবং ইচ্ছা মাফিক। আর স্থানীয় প্রশাসনও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এ বিষয়ে সামনে এগিয়ে যাননি বেশি দূর। আর এ সুযোগটা লুফে নেয় পাহাড় খেকোরা। এ কারণেই এখন সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসের আশঙ্কার বিষয়টি সামনে আসছে পাহাড়ি জনপদ নাইক্ষ্যংছড়ি।

অপরদিকে, কক্সবাজার আবহওয়া অফিসের ইনচার্জ বলেন, বর্তমানে বৃষ্টি হচ্ছে তিনদিন যাবত। সামনে আরও হবে। তবে পাহাড় কেটে মাটি সরানো পাহাড় গুলো ধসের আশঙ্কায় থাকে সব সময়। কেননা এ সময়ে হিলি সয়েলগুলো নরম হয়ে এদিক-ওদিক সরে গিয়ে ধস নামতে পারে সিরিয়াসলি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে শুধু বঙ্গোপসাগরের জন্যে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত রয়েছে থাকবে আরও ক’দিন। উপকূলীয় বসতির জন্যে নয়।

এই রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে ভারী বর্ষণ ও দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন