দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমকে হণ্য হয়ে খুঁজছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী

টেকনাফ প্রতিনিধি:

কক্সবাজারের টেকনাফে এতদিনেও কেন দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা জঙ্গি আবদুল হাকিমের (পুলিশের ভাষায় ডাকাত আবদুল হাকিম) এর আস্তানায় হানা দেওয়া হলো না? ডজনখানেক সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে টেকনাফ সীমান্তে মাসের পর মাস এই ভিনদেশি একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি একদম ফ্রিস্টাইলে কিভাবে অপকর্ম করে বেড়ায়? টেকনাফের উপজেলা প্রশাসনিক ভবন ও বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের অনতিদূরে সরকারি বনাঞ্চলের শত একরের গহীন অরণ্যে কিভাবে আবদুল হাকিম তার আস্তানা স্থাপন করে? এতবড় মাপের একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী সীমান্ত এলাকায় বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে অতিবাহিত করে কিভাবে ? এমনই অনেক প্রশ্ন স্থানীয়দের মনে।

স্থানীয়রা জানান, এ আস্তানায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ, ইয়াবা ব্যবসা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি, লুটপাট থেকে শুরু করে যত অপকর্ম কিভাবে চলে দীর্ঘ সময় ধরে? সন্দেহ করা হচ্ছে এই দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা আবদুল হাকিমের বাহিনীর সদস্যরাও নয়াপাড়া আনসার ক্যাম্পে ভয়াল হামলা, মিয়ানমারের চৌকিতে হামলার ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে।

মিয়ানমারের চৌকিতে হামলার বেশ কয়েকদিন আগে টেকনাফ সমুদ্র সৈকত হতে একটি স্টিমার যোগে শাহপরীর দ্বীপ যায়। সেখান থেকে আবার একটি ট্রলারে করে মিয়ানমারে ঢুকে পড়ে। এর কয়েক দিন পরে মিয়ানমারের চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর সে মিয়ানমার থেকে নৌকাযোগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে তার আস্তায়।

তার বিরুদ্ধে টেকনাফ মডেল থানার মামলা নং-৪৬/১৬ইং, টেকনাফ মডেল থানার মামলা নং-৪৭/১৬ইং, টেকনাফ মডেল থানার এফআর নং-১০/১৬ইং, টেকনাফ মডেল থানার এফআর নং-৪৪/৩০৯,জিআর নং-৪১৫/১৫ইং, টেকনাফ মডেল থানার এফআর নং-৪৩/৩০৮, জিআর নং-৪১৫/১৫ইং, টেকনাফ মডেল থানার মামলা নং-৩৮৬১/১৬, টেকনাফ মডেল থানার এফআর নং-২৭,জিআর নং-৪১৫/১৫ইংসহ পুরান পল্লানপাড়ার লাল মিয়ার ছেলে মো: আলী সিএনজি ড্রাইভার হত্যা, আবদুল লতিফের ছেলে নুরুল কবির, মুন্ডি সেলিম হত্যা, নতুন পল্লানপাড়ার সিরাজ মেম্বার হত্যা,  মিয়ানমারের হাসসুরাতার আবুল কাসিমকে অপহরণের পর ১৫ লাখ মুক্তিপণ আদায় করে গুলি করে হত্যা করেছে তার অস্ত্রধারী সাঙ্গপাঙ্গরা। এছাড়া পুরান পল্লানপাড়ার নুরুর কাছ থেকে ৮ লাখ, সেলিমের কাছ থেকে ৫ লাখ,  টমেটোর কাছ থেকে ৪০ হাজার,  ছুরা খাতুনের কাছ থেক ৪০ হাজার, শাহপরীরদ্বীপে বসবাসরত বার্মাইয়া জানে আলমের কাছ থেকে  ১০ লাখ, শফিউল্লাহ মাঝি থেকে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন।

মিয়ানমারের ভুচিদং এলাকার জয়নাল আলী প্রকাশ জানে আলম পুত্র আবদুল হাকিম ডাকাত টেকনাফ পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরএসও’র প্রশিক্ষণ নেয়। পরবর্তীতে তার আরও ৫ ভাই বশির আহমদ, কবির আহমদ, নজির আহমদ, হামিদ হোছনকে নিয়ে আসে এপারে। আবদুল হাকিম ও তার অপর ৫ ভাই আরাকানে খুন-খারাবির বহু অভিযোগে অভিযুক্ত। টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শক্তি অর্জনের পর এই দুর্ধর্ষ জঙ্গি আবদুল হাকিম টেকনাফ বন রেঞ্জের উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকের আনুমানিক এক কিলোমিটার দূরত্বের বনভূমি দখল করে নেয়।

রোহিঙ্গা হাকিম ফকিরামুরা এবং উড়নিমুরা নামে পরিচিত গহীন বনের বিশাল এলাকায় গড়ে তুলে আস্তানা। এখানে তার বাহিনীর আরো অর্ধশতাধিক অস্ত্রধারী ক্যাডারও রয়েছে বসতি। হাকিম আরাকানে দুটি বিয়ের পর টেকনাফের পুরান পল্লান পাড়ায়ও আরো একটি বিয়ে করে। তার ভাই নজির আহমদ বিয়ে করেছেন প্রভাবশালী জাহাঙ্গীরের কন্যা। এভাবে প্রভাবশালী লোকজনকে আত্মীয় বানিয়ে জঙ্গি হাকিম আরো শক্তি অর্জন করে। অভিযোগ রয়েছে এখন প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় রয়েছে এই জঙ্গি।

টেকনাফের ফকিরামুরা এলাকার বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গা আবদুল হাকিমের শক্তি এত বেশি যে-তার বিরুদ্ধে কযেক দফা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের পরও এ যাবৎ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া সম্ভব হয়নি। মিয়ানমার থেকে চালানে চালান ইয়াবা এনে এই হাকিম তার আস্তানায় স্টক গড়ে তোলে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এমনকি আরাকান থেকেও লোকজনকে অপহরণের পর আস্তানায় আটকিয়ে আদায় করা হয় বিপুল অংকের টাকা। গহীন অরণ্যের ঘাঁটিতে দেয়া হয় জঙ্গি প্রশিক্ষনও। কিন্তু ধরা পড়ে না আবদুল হাকিম।

সরকারি বনাঞ্চলে রোহিঙ্গা জঙ্গি আবদুল হাকিমের আস্তানা থাকার কথা স্বীকার করে টেকনাফের বন রেঞ্জ কর্মকর্তা তাপস রক্ষিত বলেন, ‘রোহিঙ্গা আবদুল হাকিমের এ রকম ভয়াল অস্ত্র ও অস্ত্রধারী সাঙ্গপাঙ্গ রয়েছে যে, পাহাড়ে যাওয়াটাই রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। তাই যান বাঁচাতেই ওই এলাকায় যাওয়া আসা করা সম্ভব হয় না।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা আবদুল হাকিমের আস্তানার কথা সরকারি মহলে সবারই জানা রয়েছে। কিন্তু করার কি আছে বলুন?’

এ প্রসঙ্গে টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিউল আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমের আস্তানার ব্যাপারে আমরা ওয়াকিবহাল রয়েছি। তাকে যেকোনো প্রকারে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম আরাকানে যেমন, তেমন আমাদের নিকটও একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিন্যাল। তাকে ধরার চেষ্টা চলছে।’

অপরদিকে টেকনাফের বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, ‘বাস্তবেই রোহিঙ্গা দুর্ধর্ষ আবদুল হাকিম বড় মাপের একজন অপরাধী। তার হাতে সব সময় অস্ত্র থাকে। ৩০-৩২ বছরের এই ক্রিমিনালকে ধরতে কয়েকবারই ফাঁদ পাতা হয়েছিল কিন্তু ব্যাটা বড় দুর্ধর্ষ, তাই সটকে গেছে।’ বিজিবি অধিনায়ক বলেন, ‘দেশের স্বার্থেই এই ভিনদেশি দুর্ধর্ষ অপরাধীকে আটক সহ তার আস্তানাও গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।’

আনসার ক্যাম্পে অস্ত্র ও আনসার কমান্ডার হত্যার পর শেষ মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যরা হণ্য হয়ে খুঁজছে দুর্ধর্ষ হাকিমকে। কিন্তু কিভাবে তাকে আটক সম্ভব? প্রতিনিয়তই তার হাতে থাকে বিদেশি অত্যাধুনিক অটো রিভলবার। তার সাথে থাকে অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী দেহরক্ষী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন