দীপংকর ও বীর বাহাদুর শান্তিচুক্তি বিরোধী

 

প্রকাশ সময়

Ousha-Tan-Talukder0220130417231811রাঙামাটি থেকে ফিরে: রাঙামটি ও বান্দরবনের সাংসদরা পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিরোধী। তারা মুখে শাস্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলেন। কিন্তু, বাস্তবে শান্তিচুক্তির বিরোধীতা করেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে–এই দুই সাংসদ শান্তিচুক্তি বিরোধী।

রাঙামাটির সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার ও বান্দরবনের সাংসদ বীর বাহাদুর উশৈ সিং-এর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ-সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য উষাতন তালুকদার। জেএসএস-এর সেকেন্ড ইন কমাণ্ড সম্প্রতি তার রাঙামাটির বাসভবনে এক একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি এসব অভিযোগ তোলেন।

দুই ঘন্টার এই সাক্ষাৎকারে উষাতন তালুকদার পার্বত্য এলাকায় জেএসএস-ইউপিডিএফ দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, আদিবাসী ও ব্যবসায়ীদের উৎকণ্ঠার কারণ, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের পদক্ষেপ, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ও কমিশন, পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও অপহরণ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সাইদ আরমান ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাজেদুল নয়ন। সঙ্গে ছিলেন সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট শোয়েব মিথুন।

উষাতন তালুকদার অভিযোগ করে বলেন, ‌‌দীপংকর তালুকদার ইউপিডিএফ-এর সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখেন। তিনি শুধু রাঙামাটিতে আসেন আর যান এবং উদ্বোধনের ফিতা কাটেন। কাজের কাজ কিছুই করছেন না।

জেএসএস নেতা বলেন, পাবর্ত্য এলাকায় বর্তমানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে, সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পথে। অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ে চলছে নানা সংকট। এদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে এখন অনেকটাই অচল অবস্থা।

চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আদিবাসী এ নেতা বলেন, সরকার দাবি করছে–চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। সরকার আরও দাবি করছে, ৮৭টি ধারার মধ্যে ৭৫টি-ই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। তবে আমাদের বক্তব্য সরকারের খারাপ লাগতে পারে। সরকার ভাবছে–আলাদা মন্ত্রণালয়, চাকরি, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, ৬শ’ আদিবাসীকে পুলিশে নিয়োগ এবং শরনার্থী তারা ফেরত এনেছে এবং অনেক কিছু করেছে।

উষাতন তালুকদার বলেন, ভূমি সমস্যার সমাধান না হলে, এগুলোর কোন কিছুই বিবেচ্য হবে না। আমরা যা পেয়েছি তার জন্য সরকারকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি ভূমি, পুলিশ ও প্রশাসন আমাদের হাতে দিতে হবে। আমাদের যদি প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকে, পুলিশ বিভাগে নিয়ন্ত্রণ না থাকে, সাধারণ প্রশাসন-এর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তবে কে কথা শুনবে।

পুলিশের নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলি তিনি বলেন, স্পষ্ট করে বলতে চাই, এতে পুলিশের মূল চরিত্র নষ্ট হবে। ব্রিট্রিশ আমলে এখানে ফ্রন্ট ইয়ার পুলিশ ছিলো। বর্তমানে রেল, শিল্প ও হাইওয়ে পুলিশ আছে। তাই পাবর্ত্য পুলিশ বা স্থানীয় পুলিশ করা যাবে না কেন? প্রশ্ন রাখেন তিনি।

পুলিশ বাহিনীর প্রস্তাবের রূপরেখা তুলে ধরে উষাতন তালুকদার বলেন, পুলিশ আইনে প্রবিধান করে একটি শাখা করা হোক। এটি মূল পুলিশের অধীনেই থাকবে। তবে কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) থাকবে আদিবাসী এবং আস্তে আস্তে সমতলের পুলিশ তুলে নিতে হবে।

স্বাধীনতার বিরোধীতার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ কখনও স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো না। পাক-ভারত স্বাধীনতার পর ধরে নেওয়া হলো পাহাড়িরা ভারতপন্থী। আবার যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়, তখন আমাদের পাকিস্তানপন্থী বলে অভিযোগ করা হলো। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য। আমাদের বেদনা হলো– দেশের মানুষকে আমরা আমাদের সমস্যা, বাস্তবতা বুঝাতে পারছি না। এখানেই আমাদের দুঃখ। যখনই আমাদের কথা বলতে যাই– আমাদের সাম্প্রদায়িক ও বিছিন্নতাবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়। নানা ষড়যন্ত্রের গন্ধ বের হয়।

জেএসএস নেতা বলেন, এখন বলা হচ্ছে, এই অঞ্চল পূর্ব তিমির হয়ে যাবে। খ্রিস্টান রাষ্ট্র হয়ে যাবে। সবসময় অন্য চোখে দেখার মানসিকা, দৃষ্টিভঙ্গি কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে আমাদের। আমরা কতটুকু বিমাতা সুলভ আচরনের শিকার তা বলে বুঝানো যাবে না।

তিনি বলেন, পাহাড়ে অনেক রাজাকার থাকতে পারে। সমতলেও তো অনেক রাজাকার আছে।

ভারতের শরনার্থীদের ১৯৭৯ সালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমান সমতলের মানুষদের পাহাড়ে ঢুকিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, রীতি, পদ্ধতি ও নিয়ম ভেঙ্গে তাদের পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। হেডম্যানের অনুমতি নেওয়া হয়নি। জমি অন্য কারো নামে বরাদ্দ আছে কিনা তা দেখা হয়নি। বরং পাহাড়িদের বাড়িঘর, ভিটামাটি ও জমি দখলে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে নানাভাবে। আদিবাসী ও বাঙালিকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে এটি করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালের পর শরনার্থীরা দেশে ফিরে এসে তাদের জমি আর ফেরত পায় নি। অনেকে নিজের বসত বাড়িতেও যেতে পারেনি এখন পর্যন্ত।

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ও কমিশন নিয়ে সরকার টালবাহানা করছে বলেও অভিযোগ করেন উষাতন তালুকদার। তার মতে, চুক্তি মোতাবেক আলোচনা ও পরামর্শ করে পাবর্ত্য সংক্রান্ত কমিশন ও আইন করতে হবে। আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু আমাদের সাথে আলোচনা ছাড়াই কমিশন গঠন করা হয়। আইনটি একই ভাবে দীর্ঘদির ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

জেএসএস নেতা অভিযোগ করেন, নানা মহল থেকে প্রস্তাবিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনটি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চাওয়ার পরও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে যে সিদ্ধান্ত হলো সেটিও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কোন ক্ষমতাধর শক্তি ক্রিয়াশীল। সেটি বের করতে হবে। অর্থাৎ সরকারের ভেতরে সরকার আছে। পর্দার আড়ালে কে বা কারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

চুক্তি বাস্তবায়ন হলে স্বাধীনতা চাইবেন কি না জানতে চাইলে উষাতন তালুকদার বলেন, আমরা সশস্ত্র আন্দোলনকালে স্বাধীনতা চাই নি। আজও চাইবো না। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও নিবেদন করে, সারা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে গিয়েছি। তবে আমরা কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করি নি। তিনি বলেন, চুক্তি বাঞ্ছাল করতে ইউপিডিএফ-কে ব্যবহার হচ্ছে।

সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে এই নেতা বলেন, চুক্তিতে আছে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে সময়টা নির্ধারিত নেই। হঠাৎ করে সব সরিয়ে নিতে আমরা বলছি না। কারণ, আইন-শৃংখলার অবনতি হতে পারে। সেটি ঠিক আছে। যেগুলো সরানো দরকার, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু সরকার এব্যাপারে একক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু সরকার সেটি করছে না। ২০১০ সালে ৩৫টি ক্যাম্প সরানো হয়। তখন ৫০০ ক্যাম্প ছিলো। সরকারের তথ্য মতে এখন ৩০০ ক্যাম্প রয়েছে। ১৬ বছরে মাত্র ২০০ ক্যাম্প সরানো হয়েছে।

চুক্তি হালনাগাদের প্রয়োজন রয়েছে কি-না জানতে চাইলে বলেন, এটির কোন দরকার নেই। তবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ও কমিশনসহ যেগুলো জটিল বিষয় এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে মানুষের পাহাড়িদের মনে আস্থা তৈরি হয়।

সাধারন আদিবাসীদের সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে এমন কথা জানিয়ে আঞ্চলিক পরিষদের এ নেতা বলেন, আদিবাসীরা মনে করতে পারছে না, এটি তাদের সরকার। কারণ, পাহাড়িদের প্রতি সরকারের বিমাতা সুলভ আচরণের কারণে তাদের মনে এটি সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক বাহিনী, প্রশাসন, পুলিশসহ সর্বস্তরে সমতলের কর্মকর্তারা থাকায়–যখনই এখানে গোলমাল দেখা দেয়, তখন পাহাড়িরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। পাহাড়ে এটি একটি বড় সমস্যা। তাই পাহাড়িদের এই অবিশ্বাস সরকারকেই দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।

 সৌজনে-বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন