দিনে পুলিশী গ্রেফতার ও রাতে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হামলার আতঙ্কে দিন কাটে নানিয়ারচরের বাঙালীদের

নানিয়ারচর

এম. সাইফুর রহমান, রাঙামাটির নানিয়াচর থেকে ফিরে :

রাঙামাটির নানিয়ারচরে অসহায় বাঙালীদের নিরব কান্না আজও থামেনি। এ কান্না এখনো পৌঁছায়নি সরকারের উর্ধ্বতন মহলে। একদিকে নিজেদের জমির ফলন্ত ফসল খুইয়ে নির্বাক নানিয়ারচরের খেটে খাওয়া বাঙালীরা, আর অন্যদিকে পুলিশী গ্রেফতার ও পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হামলার ভয়ে নির্ঘুম দিন কাটছে তাদের।

সাম্প্রতি ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ক্ষাতিগ্রস্তরা সাংবাদিকদের অভিযোগ করে বলেন, দুই দফায় তাদের সৃজিত প্রায় ৭ লাখ আনারস ও অর্ধ লাখ সেগুন গাছ কেটেও শান্ত হয়নি পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। তারা বাঙালীদের পাহাড় থেকে বিতাড়িত করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। আর তাদের ষড়যন্ত্রে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও দেশী-বিদেশী এনজিও এবং দাতাগোষ্ঠী। পরিদর্শনে যাওয়া বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব কথা বলেন নানিয়ারচরের ৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের তরুণীকার্বারীপাড়া ও ২নং নানিয়ারচর ইউনিয়নের তৈচাকমা এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালীরা।

10917595_809582409112278_1011673690_n
তাদের মতে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরে সেনাক্যাম্প তুলে নেয়ার পর থেকেই পাহাড়ীরা বাঙালীদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় ১৫ ডিসেম্বর রাতে নানিয়ারচরের ৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের তরুণীকার্বারীপাড়া এলাকায় বাঙালীদরে সৃজিত অনারস বাগান ও সেগুন গাছ ধ্বংস করে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। আর এ ঘটনার ক্ষত না শুকাতেই গত ৬ জানুয়ারি রাতে ২নং নানিয়ারচর ইউনিয়নের তৈচাকমা এলাকায় বাঙালীদের আনারস ও সেগুন বাগানের উপর পুনরায় থাবা মারে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা।

দুই দফায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা তাদের সৃজিত প্রায় ৭ লাখ আনারস ও অর্ধ লাখ সেগুন গাছ ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা স্থানীয় বাঙালীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেছে। নিজেদের রুটি-রুজির শেষ ব্যবস্থাটুকু খুইয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া এসব দিনমজুর বাঙালীরা মামলার ভয়ে শীতের রাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার পর পরই পুরুষ শুন্য হয়ে পড়ে গ্রামগুলো। স্থানীয় বাঙালীদের অভিযোগ পুলিশ পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের দায়ের করা মামলায় বাঙালীদের হয়রানী করলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালীদের দায়ের করা মামলায় পাহাড়ীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বীর দর্পে।

৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের তরুণীকার্বারীপাড়া এলাকার মো: নুরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা বাগান ধ্বংস করে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে আমাকে পথে বসতে হবে। আমি মহাজনের দাদনের প্রায় ২০ লাখ টাকা দেনা মাথায় নিয়ে ঘুরছি। আমার বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

10937553_810093429061176_1443311810_n

মো: নুরুল ইসলামের বাগানের শ্রমিক বয়োবৃদ্ধ বিধবা নুরজাহান বেগম জানান, বাগানে কাজ করে আমরা বেচে ছিলাম। আমাদের কাজ করে খাওয়ার পথ বন্ধ করে দিলো তারা। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একসময় শান্তিবাহিনী আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে আর এবার সন্ত্রাসীরা আমার রুটি-রুজির জায়গাটা কেড়ে নিলো। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের ভোট নিয়ে তিনি মা-বাবা আর ভাইদের হত্যাকারীদের ফাঁসি দিলেও আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের হত্যাকারী পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের বিচার করতে পারেন নাই।

নানিয়ারচর ভুমি উদ্ধার কমিটির আহবায়ক মো: মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, তথাকাথিত পাহাড়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মোটা অঙ্কের আর্থিক অনুদান প্রদান করা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালীদের নামমাত্র আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। অনুদান প্রদানে বাঙালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ তুলে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিদের যথাযথ ক্ষতিপুরণ প্রদান, তাদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ বগাছড়িতে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের জোর দাবি জানান।

অন্যদিকে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয়রা অভিযাগ করেন, বাঙালীরা আনারস বাগান কর্তনের অভিযোগ তুলে পরিকল্পিতভাবে তাদের বসতবাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এতে বসত বাড়ি হারিয়ে তার নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাই দ্রুত তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের জোর দাবি জানান।

নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নুরুজজামান জানান, ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি ও সকল সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অচিরেই তাদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ন পদে থাকা অবস্থায় তার উপর উপজাতী সন্ত্রাসীদের হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পুনর্বাসন কার্যক্রম শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করার লক্ষ্যে এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

নানিয়ারচর জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মোঃ সোহেল জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অতিরিক্ত সেনা-পুলিশ মোতায়েন সহ এলাকার আইন-শৃংখলা রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা টহল অব্যহত রয়েছে। আমরা পাহাড়ী-বাঙালী উভয়ের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এখানকার সাধারণ মানুষের মাঝে যে আতংক বিরাজ করছে তা অচিরেই কাটিয়ে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন