তিন পাহাড়ে উড়ছে টাকা

চাঁদাবাজী
শফিউল আলম :
তিন পার্বত্য জেলায় জুমের ফসল ঘরে তোলার ভরা মওসুম চলছে। পাহাড়ি কৃষক-কিষানিরা জুমের ধান কাটছেন। কিন্তু সোনার ধানসহ সব ধরনের ফল-ফসল, সবজির জন্য ‘বাধ্যতামূলক’ চাঁদার ভাগ বসাচ্ছে পাহাড়ি চাঁদাবাজরা। কৃষকের মনে নেই শান্তি। আগামীর দিনগুলো যেন অনিশ্চয়তায় ভরা।
শুধু ফল-ফসলই নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, খামার, ঠিকাদারি, উন্নয়নমূলক কাজেও চাঁদাবাজি চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় অহরহ খুন, গুম, অপহরণ, সশস্ত্র সন্ত্রাস, ডাকাতি, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটছে। সে সাথে পাহাড় থেকে পাহাড়ে চলছে চলছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজির নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। উপজাতি-বাঙালি নির্বিশেষে তিন পার্বত্য জেলার নিরীহ লোকজন সশস্ত্র পাহাড়ি বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ, সংগঠন ও চাঁদাবাজদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নামে-বেনামে প্রায় এক ডজন সন্ত্রাসী সংগঠন, গ্রুপ কিংবা দলছুট গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে কম-বেশি সক্রিয়। একেকটি গ্রুপ একেক এলাকায় তৎপর রয়েছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসী এসব গ্রুপ চাঁদাবাজির মাধ্যমে দিনে আদায় করছে এক থেকে দেড় কোটি টাকা। বহুমুখী অপকৌশলে সংগৃহীত চাঁদার অর্থে তহবিল করছে গ্রুপগুলো। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের কর্মকা- পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃৃত।
অন্যমিডিয়া
চাঁদাবাজির মূলে রয়েছে প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাসহ নিজেদের অবস্থান সংহত করা। চাঁদাবাজির মাধ্যমে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সংগ্রহ, নাশকতামূলক অপতৎপরতা এবং পাহাড়-জঙ্গলের গোপন ও দুর্গম উপত্যকায় ভ্রাম্যমাণ আস্তানায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানে মাঝে-মধ্যেই অস্ত্রসহ গ্রুপের সদস্যরা ধরা পড়ছে।
সূত্র জানায়, পশ্চিমা কতিপয় সংগঠনের সাহায্য-সমর্থনপুষ্ট হয়ে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। পার্বত্যাঞ্চলে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বহির্বিশ্বে তারা অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর বিনিময়ে সন্ত্রাসীদের হোতারা ঘন ঘন বিদেশ সফর করে নিজেরাই আর্থিক ও বৈষয়িক বিভিন্ন অপকৌশলে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো প্রকাশ্যে চাঁদা আদায়কে ‘ট্যাক্স’ বলছে। নির্দিষ্ট হারে কথিত ট্যাক্সের নগদ টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নেতা-ক্যাডারদের হাতে পৌঁছানো বাধ্যতামূলক।
জানা গেছে, ‘ট্যাক্স’ নামের অবৈধ চাঁদা না দিলে এলাকায় নিজের বাড়িঘরে বসবাস করাসহ ব্যবসা, কাজ-কারবার টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। যখন-তখন নেমে আসে অত্যাচার-নিপীড়ন, লুটতরাজ, অপহরণ, জানমাল অনিষ্টের হুমকি। চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে পুলিশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে যেতে পর্যন্ত সাহস পান না নিরীহ লোকজন।
পার্বত্যবাসী নিরীহ বাঙালিরাই প্রধানত সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির প্রধান টার্গেট। এর পরের অবস্থানে রয়েছে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত ১৩টি ছোট-বড় উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর যেমন- তংচইঙ্গা, খুমি,
চাক, ম্রোং, পাংখো, লুসাই উপজাতি লোকজন। মার্মা, ত্রিপুরারাও ক্ষেত্র বিশেষে চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে চাকমাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবির তেমন ঘটনা শোনা যায় না।
স্থানীয়রা জানান, বাঁশ, বেত, কাঠ, ছন সংগ্রহ, বেচাকেনা ও পরিবহন, কৃষি-খামার, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়ক ও নৌপথে মালামাল পরিবহন থেকে শুরু করে ঠিকাদারি, অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সবকিছুর ওপর থেকেই জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা কলা, আদা, হলুদ, আনারস, লেবু, কমলা, খাদ্যশস্য চাষাবাদ, গবাদিপশু-পাখি বেচাকেনা করতে গিয়েও চাঁদা পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির কারণে পার্বত্য জেলায় উন্নয়ন কর্মকা- অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে চাঁদাবাজির শীর্ষে রয়েছে শান্তিচুক্তি বিরোধী সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চুক্তি সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ক্যাডাররা। এদের অঙ্গসংগঠন যেমন- পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইম্যান ফেডারেশন বিভিন্ন অপকৌশলে পাহাড়ে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি, বিলুপ্ত ঘোষিত তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’র দলছুট বিভিন্ন গ্রুপ এবং এর পাশাপাশি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে-বেনামে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি করেছে।
তিন জেলার প্রত্যন্ত দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলাকীর্ণ বেশকিছু এলাকায় পশ্চিমা খ্রিস্টান মিশনারির কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘ্নে চলছে। পিতৃ পুরুষের ধর্ম-কৃষ্টি হারিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি নাগরিক অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে, দুর্গম পাহাড়ে খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কোনরকম চাঁদা বা ‘ট্যাক্স’ আদায় করে না। এমনকি কোনরকম বাধা-বিপত্তিও এ ক্ষেত্রে নেই।
♦ সৌজন্যে- দৈনিক ইনকিলাব

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন