তিন পার্বত্য জেলা : আবারও বেপরোয়া পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা

Bandarban-Arms-pic-3
মনির হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে:
দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাহাড়ি কিছু সন্ত্রাসী। খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। শুধু বাঙালিই নয়, এসব সন্ত্রাসীর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও।
স্থানীয়রা বলছেন, আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সশস্ত্র উইংগুলোই এখন অশান্ত করে রেখেছে পুরো পাহাড়ি অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ি ও বাঙালিরা মিলে এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে।
জানতে চাইলে পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যেকটি সেক্টর থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়। শুধু বাঙালিরাই নয়, পাহাড়িরাও সন্ত্রাসীদের চাঁদা দেয়। তিনি বলেন, তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের ভারি অস্ত্র আছে। পুলিশও সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। এসব সন্ত্রাসী একমাত্র সেনাবাহিনী ছাড়া পাহাড়ের কাউকে ভয় পায় না। সরকারের পক্ষ থেকেও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। চিনু বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি, আমাদের চাঁদাবাজ ও অস্ত্রবাজদের হাত থেকে বাঁচান।

জানা গেছে, দেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। পাহাড়, নদীনালা ও গাছপালা বেষ্টিত অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ ভূমিতে রয়েছে বাঙালি ও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। পর্যটন শিল্পের জন্য রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য তা আজ ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে।

পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। জেএসএসের (সন্তু লারমা) সঙ্গে করা এ চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে, পাহাড়িদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করে তারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে। সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করা হলেও হানাহানি বন্ধ করেনি এখানকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এখনও চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি।

স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে জড়িত নয়। এসব প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীর ভয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও মুখ খোলেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এ এলাকায় চাকরি করেন, তারা শুধু দিন গণনা করেন কবে এ এলাকা থেকে বদলি হবেন। কোনো কোনো থানার ওসিও ভয়ে ওই সন্ত্রাসীদের তৎপরতা সম্পর্কে এড়িয়ে যান। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়।

বান্দরবান যুবলীগের আহবায়ক কিউচিং মারমা বলেন, সন্ত্রাসীদের কাছে তারা অসহায়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেই ক্ষতির শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ১৩ জুন অপহৃত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য বাবু মংপু মারমা। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। যুবলীগের ওই নেতা জানান, জেএসএসের সন্ত্রাসীরা তাকে তিনবার অপহরণ করেছে। বিভিন্নভাবে ছাড়া পেয়েছেন।

বান্দরবানের রাজভিলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কেশৈ অং মারমা বলেন, আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। শান্তি চাই। কিন্তু সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা অপহরণ করছে। কাউকে কাউকে অপহরণের হুমকি দিচ্ছে।

বান্দরবান উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক ও কুহালাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সানুপ্রু মারমা, উপজাতীয় সম্প্রদায়ের নেতা মেসাসিং মারমা এবং এমি প্রু মারমাসহ অনেকেই বলেন, সন্ত্রাসীদের কাছে তারা জিম্মি। তারা শান্তিতে থাকতে চান। কিন্তু সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ।

এসব সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানাতে ২৩ জুন বান্দরবান প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হয়েছিলেন ভুক্তভোগী পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের শত শত সাধারণ মানুষ। সমাবেশে বক্তারা জেএসএস ও ইউপিডিএফের অব্যাহত চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণের প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপজাতি কোটার পুরোটা চাকমারাই ভোগ করছে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সব নৃগোষ্ঠীর সমান অধিকারের দাবি জানান তারা। এছাড়া বান্দরবানের পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া ঐতিহাসিক স্বর্ণমন্দির পুনরায় খুলে দেয়ার দাবিও জানান।

এর আগের দিন রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে স্থানীয় বাঙালিরা। এক চাকমা কিশোরীকে ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করে তারা ওই সমাবেশ করে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, এখানে চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গুম হয় কিন্তু থানায় মানুষ মামলা দায়ের করে না। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার মনসুর আলী বলেন, ১৩ জুন তার স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে স্থানীয় ঘিলা তঞ্চঙ্গার ছেলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পিসিপির সদস্য কাজল তঞ্চঙ্গা।

ওই গৃহবধূ জানান, কাজল তার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে তার কাপড় খোলার চেষ্টা করে। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তার গলার স্বর্ণালংকার নিয়ে কেটে পড়ে কাজল। রোয়াংছড়ি থানার ৩০০ গজের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান চহ্লা মং মারমাকে বিচার দেয়া হলে তিনি কাজলকে কয়েকটি চড়-থাপ্পড় মেরে বিচার শেষ করেন। ওই গৃহবধূ বলেন, থানায় মামলা করবেন তার সাহস পাচ্ছেন না। মামলা করলে মেরেই ফেলবে।

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, ঘটনা কিছু ঘটে ঠিকই, কিন্তু মামলা হয় না। বাদী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এই থানায় চলতি বছরের ৬ মাসে মামলা হয়েছে মাত্র ৩টি। ২০১৫ সালে মামলা হয় ৬টি, আর ২০১৪ সালে হয় মাত্র ২টি।

পার্বত্য এলাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটলেও নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবননাশের ভয়ে সিংহভাগ ঘটনায় থানায় কেউ মামলা করেন না।

বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অংচাখই কার্বারী, উপজেলা আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি শাকুয়াই মারমা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক প্রহর কান্তি চাকমা জানান, পার্বত্য এলাকায় চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। জেএসএস ও ইউপিডিএফ এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
তবে বিলাইছড়ির কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, এ এলাকায় ২০০৭-এর পরে ইউপিডিএফ নেই। পুরো এলাকা জেএসএস নিয়ন্ত্রণ করছে। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে ৪টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতেই জয়ী হয় জেএসএস।
তারা জানান, তাদের হাতে অস্ত্র আছে। তাদের কথা মানতেই হবে। না হলে বিভিন্ন ক্ষতি করবে। অংচাখই কার্বারী বলেন, আমরা তো জঙ্গলে বাস করি। আমাদের জঙ্গলে যেতে হয়। পুলিশ তো সারাক্ষণ সঙ্গে থাকবে না।

স্থানীয় সূত্র জানায়, এ বছরের ১৫ এপ্রিল বান্দরবানের লামায় উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় তিন বাঙালি গরু ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় তিন সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়। ১৩ জুন অস্ত্রের মুখে অপহরণ হয় বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য মংপু মারমা। এ ঘটনায় জেএসএসের ৩৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পরিবার।

এর আগে ৩০ মে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে জেএসএস কর্মীরা মুকুল কান্তি চাকমা নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সার্জেন্টকে ডেকে নেয়ার পর আজও তার খোঁজ মেলেনি। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির সাজেকে এক সেনা কর্মকর্তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার গাড়িতে আগুন দেয় উপজাতি সন্ত্রাসীরা।

২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় জেএসএসের ৫ সন্ত্রাসী। উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র। একই বছরের ২৬ জুলাই রাঙ্গামাটিতে জেএসএস-ইউপিডিএফ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৩ জন এবং ২৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে জেএসএস-ইউপিডিএফের আরেকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী ভারি আগ্নেয়াস্ত্র।

স্থানীয়রা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা শান্তি চুক্তির পূর্ণ দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন, যা নিয়ে তারা চিন্তিত। এলাকার মানুষ চরম ভয়ের মধ্যে আছে বলে জানান তারা।

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের খবর আসে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে অতি গোপনেও মুখ খুলতে চায় না কেউ।

-সূত্র; যুগান্তর
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন