তিন পার্বত্য জেলা : আবারও বেপরোয়া পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা
জানা গেছে, দেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। পাহাড়, নদীনালা ও গাছপালা বেষ্টিত অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ ভূমিতে রয়েছে বাঙালি ও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। পর্যটন শিল্পের জন্য রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য তা আজ ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে।
পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। জেএসএসের (সন্তু লারমা) সঙ্গে করা এ চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে, পাহাড়িদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করে তারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে। সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করা হলেও হানাহানি বন্ধ করেনি এখানকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এখনও চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি।
স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে জড়িত নয়। এসব প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীর ভয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও মুখ খোলেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এ এলাকায় চাকরি করেন, তারা শুধু দিন গণনা করেন কবে এ এলাকা থেকে বদলি হবেন। কোনো কোনো থানার ওসিও ভয়ে ওই সন্ত্রাসীদের তৎপরতা সম্পর্কে এড়িয়ে যান। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়।
বান্দরবান যুবলীগের আহবায়ক কিউচিং মারমা বলেন, সন্ত্রাসীদের কাছে তারা অসহায়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেই ক্ষতির শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ১৩ জুন অপহৃত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য বাবু মংপু মারমা। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। যুবলীগের ওই নেতা জানান, জেএসএসের সন্ত্রাসীরা তাকে তিনবার অপহরণ করেছে। বিভিন্নভাবে ছাড়া পেয়েছেন।
বান্দরবানের রাজভিলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কেশৈ অং মারমা বলেন, আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। শান্তি চাই। কিন্তু সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা অপহরণ করছে। কাউকে কাউকে অপহরণের হুমকি দিচ্ছে।
এসব সন্ত্রাসের প্রতিবাদ জানাতে ২৩ জুন বান্দরবান প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হয়েছিলেন ভুক্তভোগী পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের শত শত সাধারণ মানুষ। সমাবেশে বক্তারা জেএসএস ও ইউপিডিএফের অব্যাহত চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণের প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপজাতি কোটার পুরোটা চাকমারাই ভোগ করছে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সব নৃগোষ্ঠীর সমান অধিকারের দাবি জানান তারা। এছাড়া বান্দরবানের পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া ঐতিহাসিক স্বর্ণমন্দির পুনরায় খুলে দেয়ার দাবিও জানান।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এখানে চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গুম হয় কিন্তু থানায় মানুষ মামলা দায়ের করে না। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার মনসুর আলী বলেন, ১৩ জুন তার স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে স্থানীয় ঘিলা তঞ্চঙ্গার ছেলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পিসিপির সদস্য কাজল তঞ্চঙ্গা।
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, ঘটনা কিছু ঘটে ঠিকই, কিন্তু মামলা হয় না। বাদী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এই থানায় চলতি বছরের ৬ মাসে মামলা হয়েছে মাত্র ৩টি। ২০১৫ সালে মামলা হয় ৬টি, আর ২০১৪ সালে হয় মাত্র ২টি।
পার্বত্য এলাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটলেও নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবননাশের ভয়ে সিংহভাগ ঘটনায় থানায় কেউ মামলা করেন না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এ বছরের ১৫ এপ্রিল বান্দরবানের লামায় উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় তিন বাঙালি গরু ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় তিন সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়। ১৩ জুন অস্ত্রের মুখে অপহরণ হয় বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য মংপু মারমা। এ ঘটনায় জেএসএসের ৩৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পরিবার।
২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় জেএসএসের ৫ সন্ত্রাসী। উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র। একই বছরের ২৬ জুলাই রাঙ্গামাটিতে জেএসএস-ইউপিডিএফ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৩ জন এবং ২৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে জেএসএস-ইউপিডিএফের আরেকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী ভারি আগ্নেয়াস্ত্র।
স্থানীয়রা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা শান্তি চুক্তির পূর্ণ দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন, যা নিয়ে তারা চিন্তিত। এলাকার মানুষ চরম ভয়ের মধ্যে আছে বলে জানান তারা।
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের খবর আসে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে অতি গোপনেও মুখ খুলতে চায় না কেউ।