তিন পার্বত্য জেলার ২১৮ উপজাতীয় পুলিশ সদস্যকে সমতলে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ

12226883_10207092080835702_1234592496_n

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট :

তিন পার্বত্য জেলায় কর্তব্যরত ২১৮ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পুলিশ সদস্যকে পর্যায়ক্রমে ফের সমতলে বদলি করতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দৈনিক আমাদের সময় নামক জাতীয় দৈনিকে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বদলি না হওয়া পর্যন্ত তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড তথা গতিবিধি গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখতে বলা হয়েছে।

 তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে এই নির্দেশ কার্যকর হবে। সমতলের উপজাতীয় সদস্যরা এর আওতাভূক্ত নয়। এরই মধ্যে এই নির্দেশে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন চলছে। প্রথম দিকে শুধুমাত্র শান্তিবাহিনী থেকে পুলিশে যোগ দেয়া সদস্যদের জন্য এই নির্দেশ থাকলেও পরে সকল পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী উপজাতীয় পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, “গত সপ্তাহে এ নির্দেশ দেওয়া ওই ২১৮ পুলিশ সদস্য সাবেক শান্তি বাহিনীর সদস্য। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী শান্তি বাহিনীর মোট ১৯৬৫ জন সশস্ত্র সদস্য আত্মসমর্পণ করলে তাদের মধ্যে ৭১৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। আনসারেও নিয়োগ পান তারা।

অন্যমিডিয়া

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৭ জানুয়ারি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় পার্বত্য জেলাগুলোয় পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত সাবেক শান্তি বাহিনীর সদস্যদের পর্যায়ক্রমে সমতলের জেলায় বদলি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে অনুরোধ করা হয় কিছুদিন আগে। এছাড়া তাদের ওপর গোপন নজরদারি করতেও অনুরোধ করা হয় সশস্ত্র বাহিনীর চিঠিতে। ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক শান্তিবাহিনী থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে আমরা অনেক আগেই পুলিশ সদর দপ্তরকে জানিয়েছি। তবে এদের সবাই খারাপ নয়। কিছু কিছু সদস্য। তাদের ওপর নজরদারি আছে। পর্যায়ক্রমে তাদের একজন-দুজন করে সমতলে সরিয়ে আনা হচ্ছে। তবে পুলিশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের সার্বিক কর্মকাণ্ড ভালো।’

কিছুদিন আগে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য জেলাগুলোয় কর্মরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পুলিশ সদস্যরা সরকারের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে। শৃঙ্খলাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। পার্বত্য এলাকার কতিপয় কুচক্রী মহলের প্রলোভন, আঞ্চলিকতা ও আত্মীয়তায় প্রভাবিত হয়ে তারা রাষ্ট্রের গোপনীয়, স্পর্শকাতর ও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত তথ্য পাহাড়ের কিছু আঞ্চলিক সংগঠনের কাছে পাচার করছে। এসব তথ্য ইউপিডিএফ, জেএসএস (সন্তু লারমা) ও জেএসএসের (সংস্কার) মতো আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাদের কাছে চলে যাচ্ছে। এমনকি দুষ্কৃতিকারী ধরতে যেসব অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তারও আগাম তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে এসব পুলিশ সদস্য।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, শান্তি চুক্তি অনুসারে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে এবং তাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিতে ২০১২ সাল থেকে সমতলের কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পুলিশ সদস্যকে পার্বত্যাঞ্চলে বদলি করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে কিছু পুলিশ সদস্য শৃঙ্খলাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে বিভাগীয় পদক্ষেপ চলমান রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

পুলিশের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পুলিশ সদস্যরা সেখানে বিভাগীয় নিয়মশৃঙ্খলা যথাযথভাবে পালন করছে না। তাদের নামে ইস্যু করা সরকারি অস্ত্র-গুলিসহ অন্যান্য মালামাল সম্পর্কেও যত্নবান নয়। বিধি মোতাবেক অর্পিত নির্দেশ ও দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করে না। এ কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন সময় পার্বত্য অঞ্চলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কর্মসূচি পালনকালে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সদস্যরা পুলিশের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল ও মারমুখী আচরণ করে। এ সময় কর্তব্যরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আন্তরিক না হয়ে কৌশলে অনেকটা নিস্ক্রিয় থাকে। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশও মানতে চায় না।

প্রতিবেদনে খাগড়াছড়ি জেলা সম্পর্কে বলা হয়, এসব পুলিশ সদস্যের পুলিশ লাইনসে সপরিবারে বসবাসের সুযোগ থাকলেও তারা সেখানে থাকে না। থাকে ইউপিডিএফ অধ্যুষিত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে। সেখানে অনেকেই আত্মীয় হওয়ায় পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান চলে।”

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের নভেম্বরে রাজধানীর কাফরুল এলাকা থেকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে কর্মরত নায়েক জেনাল চাকমা ও প্রেম চাকমাকে একে-৪৭ রাইফেলের ৫০০ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যে গুলি পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের কাছে বিক্রির কথা ছিল তাদের। ওই ঘটনা তদন্তে পরবর্তীকালে কতিপয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত পুলিশ সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃত্তান্ত উঠে আসে। এরপর ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পানছড়িতে পুলিশের নায়েক লক্ষীকুমার চাকমা ডিউটিরত অবস্থায় এমএমজি হারিয়ে ফেলে। লক্ষীকুমার চাকমা শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্য। সে শান্তিবাহিনীর সাবেক সহকর্মীদের কাছে অস্ত্রটি পাচার করেছে বলে সে সময় অভিযোগ উঠেছিল।

পাহাড়ি সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, পুলিশকে পুলিশ হিসেবে দেখা উচিত। বাঙালি বা উপজাতি হিসেবে নয়। এতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। পুলিশ বাহিনীতে কে কোন জাতি-ধর্ম থেকে এসেছে, সেটার মাধ্যমে বিভাজন বা পদায়ন করা গ্রহণযোগ্য নয় বলেও তারা মনে করেন।

ছবি: খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলা এসএমজি হারানো পুলিশের নাযেক লক্ষী কুমার চাকমা 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন