তিন চাকের হলো মেলা ঢাবি এসে

fec-image

মীর হুযাইফা আল মামদূহ:

১২শ’ শতকের কথা। চাক রাজা য়েংচোকে উৎখাত করে সেখানকার মারমারা। রাজার ছেলে চতুং তাঁর আশপাশের মানুষদের নিয়ে চলে আসেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। এরপর থেকে সেখানেই বাস তাঁদের। এত দিনে বংশবৃদ্ধি হয়েছে। তবে সংখ্যায় বেশি নয়। বাংলাদেশে এখন চাকগোষ্ঠীর বাসিন্দা আছে মাত্র পাঁচ হাজার। এঁদের মধ্যে এখন তিনজন পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নাইক্ষ্যংছড়ি আর বাইশারি—বান্দরবানের এ দুই ইউনিয়নে পাঁচ হাজার চাক সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। এই পাঁচ হাজারের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তিনজন।

তাঁরা হলেন—মংহ্লাচিং চাক, এ ছাই মং চাক ও থোয়াই নু অং চাক। মংহ্লাচিং চাক আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে, এ ছাই মং চাক অর্থনীতি প্রথম বর্ষে এবং থোয়াই নু অং চাক পড়ছেন মার্কেটিংয়ের চতুর্থ বর্ষে। থোয়াই নু অংকে সবাই কেনি নামেই চেনে। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় তাঁর বেড়ে ওঠা। বাকি দুজন শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়িতেই।

অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাক জনগোষ্ঠীর তাঁরাই প্রথম নন। নব্বইয়ের দশকেও পড়ে গেছেন দুই-তিনজন। মংহ্লাচিংয়ের দুলাভাই সম্পর্কের অঙথোয়াই গ্য, ক্যজোইং—এঁরা পড়েছিলেন সে সময়। এরপর একটা বড় বিরতি। পরে কেটিলা চাক নামে একজন পড়েছেন ২০১০ সালে।

দীর্ঘ বিরতির কারণ একটাই—শিক্ষায় এ জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকা। এখন যে তিনজন পড়ছেন তাঁরা বলছিলেন, ‘আমাদের উৎসব অনেক। কেউ চাইলে একটা জীবন শুধু উৎসব করে কাটিয়ে দিতে পারবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটাই হয়। এই উৎসব প্রিয়তা আমাদের সমাজটাকে আলসে বানিয়ে দিয়েছিল। পড়াশোনায় কেউ অতটা জোর দেয়নি। টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যেতে হয়েছে আমাদের। তাছাড়া আমাদের জনগোষ্ঠীর মানুষের আর্থিক সক্ষমতাও বেশি নয়। মা-বাবা চাইলেই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় বাইরে পাঠাতে পারেন না। বড়জোর দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে পারেন। এখন অবশ্য বেশ কিছু সংস্থা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।’

মংহ্লা জানালেন, ‘আমার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। আমাকে সবটুকু পড়ানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। ক্লাস ফাইভে থাকাকালীন একদিন শুনতে পাই, লামায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন পাহাড়ি শিশুদের জন্য স্কুল খুলেছে। সেখানে ফ্রি পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে। আবাসিক স্কুল। সেখানে গেলাম। জায়গাটা দুর্গম। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে গাড়িতে দুই ঘণ্টার পথ। তারপর আবার এক ঘণ্টা জঙ্গলের ভেতর হাঁটলে ওই স্কুল। ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেলাম। তারপর থেকে তাঁদের খরচেই আমার পড়াশোনা চলছে।

এ ছাই অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এপিএবির অনুদানে পড়েছেন এসএসসি পর্যন্ত। তার পর থেকে কখনো বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে, কখনো টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন।

এতো গেল তাঁদের গল্প। চাকগোষ্ঠী নিয়ে জানতে চাইলে তাঁরা বললেন, ‘চাকরা প্রধানত দুটি গোত্রে বিভক্ত— আন্দো ও ঙারেক। এদের কয়েকটা উপগোত্র আছে। যেমন—আন্দোর, আঠাক আন্দো। আর ঙারেকের আছে ক্যাংকাবাংছা। জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই ধর্মে বৌদ্ধ হলেও অনেকেই এখন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। আমাদের নিজস্ব চাক ভাষা আছে। পোশাকেও আছে ভিন্নতা। আছে অলংকার পরার নিজস্ব রীতি। চাক মেয়েদের চেনার একটা উপায় হচ্ছে, এরা কানের পর্দা গোল করে ছিদ্র করে তার ভেতর দুল পরবে। ক্রমে সেই দুল আর ছিদ্র দুটিই বড় হবে। ‘বড় কানে’র জাতি হিসেবে আমাদের একটা আন্তর্জাতিক পরিচিতিও আছে। তাঁত আমরা নিজেরা তৈরি করে তা দিয়ে পোশাক বানিয়ে পরতাম। এসব ছিল আমাদের নিজস্বতা। অনেক কিছুই হারাতে বসেছে। এখন মারমাদের অনেক কিছুই আমরা গ্রহণ করে ফেলছি। যেমন— ওদের পোশাক পরি। ভাষার ক্ষেত্রে ওদের সংখ্যা গণনার পদ্ধতি অনুসরণ করছি। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে আমাদের রীতি আলাদা— একই গোত্রের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। বিয়েতে বড় উৎসব হয়। মানুষ মারা গেলে ঘটা করে শেষকৃত্য হয়। এসবের জন্য আবার আমাদের নিজস্ব সংগীতও আছে।’

কথায় কথায় তাঁরা আরও জানালেন, ‘এখন বেশ পরিবর্তন আসছে। আমাদের ভেতরে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। লোকজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। ভাষা নিয়েও কাজ হচ্ছে। বর্ণমালা তৈরি হয়েছে। চাক-ইংরেজি-বাংলা একটা ডিকশনারি বানানো হয়েছে। সত্যেন চাক নামে একজন চাক ভাষায় গল্প-কবিতাও লিখছেন। উ সা চিং চাক ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রথম শিক্ষিত মং মং চাক আমাদের সংস্কৃতি রক্ষায় বেশ আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সফলতা আসছে। এই সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে প্রায় ৩০ জনের মতো চাক ছেলে-মেয়ে পড়ছে। তবে চাক মেয়েরা এখনো বেশ পিছিয়ে। তাদের জন্যও অনেক কাজ বাকি।’

নিজের গোষ্ঠীর লোকদের জন্য কার কী পরিকল্পনা? মংহ্লা বললেন, ‘উচ্চশিক্ষায় যাঁরা আসতে চান, তাঁদের জন্য সাধ্যমতো সব সহায়তা করব।’ জানা গেল, এ ছাইও এর জন্য মংহ্লার কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি বললেন, ‘নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার কাজ করব। এলাকায় একটা পাঠাগার করব। যাতে পড়ুয়া হয়ে ওঠে নিজের গোষ্ঠী।’

কেনি বললেন, ‘ভবিষ্যতে চাক তরুণদের ক্যারিয়ার-বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে চাই। তার আগে চাকদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে। এ জন্য সবার সহযোগিতা পাব বলে আশা রাখি।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: তিন চাকের হলো মেলা ঢাবি এসে
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন