টেন্ডার জালিয়াতি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে উত্তেজনা: ঠিকাদারদের বিক্ষোভ স্মারকলিপি পেশ

pic-2 copy
চৌধুরী হারুনুর রশীদ:
রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের গোপনে টেন্ডার জালিয়াতির অভিযোগে বুধবার সকাল-দুপুর বোর্ডের রাঙ্গামাটির প্রধান কার্যালয় চত্ত্বরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় অফিস ত্যাগ করে গা ঢাকা দেন বোর্ডের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

অভিযোগ উঠেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের দূর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে প্রকাশ্য টেন্ডার আহবান না করে প্রতিবারই গোপনে নিজেদের মধ্যে কাজগুলো ভাগ-বাটোয়ারা করে জালিয়াতি করা হয়। মঙ্গলবার ২৩ গ্রুপের কাজের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার টেন্ডারের (নং-১(৩), ২০১৪-১৫) গোপন জালিয়াতির তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এ জালিয়াত টেন্ডারে বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দীন চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান তরুণ কান্তি ঘোষসহ দূর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন বঞ্চিত ঠিকাদাররা।

তবে অভিযোগ এড়িয়ে উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তরুণ কান্তি ঘোষ দাবি করে বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া শতভাগ স্বচ্ছতায় রয়েছে। এ নিয়ে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে সেগুলো মিথ্যা। ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে বোর্ডের মধ্যে ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি গোপন টেন্ডারের অভিযোগ এড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এখন প্রকাশ্যে টেন্ডার আহবান করা হবে। পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে।

এদিকে টেন্ডার জালিয়াতি ও দূর্নীতির প্রতিবাদ ও পুন:টেন্ডার আহবানসহ তিন কর্মকর্তার অপসারণ দাবিতে বুধবার সকালে বোর্ডের রাঙ্গামাটির প্রধান কার্যালয়ের সামনে তাৎক্ষণিক মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে টেন্ডারবঞ্চিত সাধারণ ঠিকাদারদের একটি অংশ। এতে নেতৃত্বে ছিলেন ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা মুজিবুর রহমান, মো. আবু মুসা, মইন উদ্দিন সেলিম, জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা উদয়ন বড়–য়া, ছাত্রলীগ নেতা শাহ জামান রিপনসহ অন্যরা। তারা টেন্ডার জালিয়াতি, দূর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান তরুণ কান্তি ঘোষ, নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাবুদ্দীন চৌধুরী ও ইলেক্ট্রিকেল এসও মিহির চাকমার অপসারণের দাবি জানান। এছাড়া মিহির-স্বপন সিন্ডিকেট থেকে উন্নয়ন বোর্ডের মুক্তির দাবি করেন তারা। এ সময় অবিলম্বে ওই তিন কর্মকর্তাকে অপসারণসহ দাবি মেনে না নিলে কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হতে হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন বিক্ষুব্ধ ঠিকাদারা।

পরে এসব দাবিতে জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফ উদ্দিন আহমদের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্দ্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রী বরাবরে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়।

এদিকে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গত ২৯ ডিসেম্বর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দীনের স্বাক্ষরে ২৩ গ্রুপ কাজের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার ওই টেন্ডার আহবান করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। টেন্ডারের সিডিউল বিক্রির শেষদিন ছিল মঙ্গলবার- যা বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে জমা দিতে বলা আছে। এরপর আহবান করা টেন্ডার নোটিসে বিকাল সাড়ে ৩টায় দরপত্র খোলার শর্ত উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারদের অভিযোগ মতে তার আগেই চিহ্নিত সিন্ডিকেটটির নিয়ন্ত্রণে কাজগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার পর গোপনে জালিয়াতি টেন্ডার প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়া হয়। উন্নয়ন বোর্ডের ওই তিন কর্মকর্তাসহ দূর্নীতিগ্রস্ত অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রিত হয় বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ ঠিকাদাররা। মিহির ও স্বপনের সিন্ডিকেট থেকে উন্নয়ন বোর্ডকে মুক্ত করার দাবি করেন ঠিকাদার মইন উদ্দিন সেলিম, ইফতেখারুল আলম, সালাম, মুসাসহ অনেকে।

তারা অভিযোগ করে জানান, গোপনে টেন্ডার জালিয়াতির খবর পেয়ে মঙ্গলবার বোর্ডের রাঙ্গামাটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে টেন্ডারে অংশ নিতে সিডিউল কেনার চেষ্টা করি। কিন্তু বোর্ডের প্রকৌশল শাখার লোকজন সিডিউল বিক্রি সম্ভব নয় বলে জানায়। ওই সময় নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাবুদ্দীন চৌধুরীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকে অফিস থেকে অবস্থান ত্যাগ করে গা ঢাকা দেয়। পরে ওইদিন বিকালের দিকে উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করে তিনি বুধবার সকাল ১১টার দিকে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। এতে আমরা উন্নয়ন বোর্ড থেকে অবস্থান ত্যাগ করি। কিন্তু বুধবার ওই সময়ে কোনো কিছু না করে টালবাহানার আশ্রয় নেন দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। এতে সাধারণ ঠিকাদারদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আমরা বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রীকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে।

স্মারকলিপির অনুলিপি দেয়া হয়েছে, চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙ্গামাটি; চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙ্গামাটি; জনাব ঊষাতন তালুকদার এম.পি; জনাব ফিরোজা বেগম চিনু এম.পি (সংরক্ষিত মহিলা আসন); রিজিয়ন কমান্ডার, ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড, রাঙ্গামাটি; অধিনায়ক, ডিজিএফআই, রাঙ্গামাটি; এনএসআই, রাঙ্গামাটি, পুলিশ সুপার, রাঙ্গামাটি; দূর্নীতি দমন কমিশন, রাঙ্গামাটিকে।

সাধারণ ঠিকাদারবৃন্দের নামে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান, নির্বাহী প্রকৌশলী ও স্টি মিটার মিহির কান্তি চাকমার অপসারণ দাবি করে বলা হয়েছে, “দীর্ঘদিন যাবৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, উন্নয়ন বোর্ড এর সরকার গৃহীত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের দরপত্র সমূহ নির্দিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদার, যা (Seven Star Recreation Club) নামে সিন্ডিকেট যথা:- মেসবাহ, স্বপন মহাজন, আশিষ (তৈল), আজম, লিটন মাঝি গং গণ উক্ত প্রতিষ্ঠানের উল্লেখিত দূর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ আত্মসাত করে আসছে।

উল্লেখ্য যে, গত অর্থ বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার কাজ ও চলতি অর্থ বছরে ২৫ কোটি টাকার কাজ যা বর্তমান রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজ ৮ কোটি, ভাইস চেয়ারম্যান বাস ভবন ৫ কোটি, আঞ্চলিক পরিষদ ভবন ৩ কোটি, বিলাইছড়ি আর.সি.সি রাস্তা ৩ কোটি এবং এইভাবে ছোট-খাট প্রায় আরো ১০ কোটি টাকার কাজ টেন্ডার কমিটির যোগসাজসে মেসবাহ-স্বপন গং’কে পাইয়ে দেয়। মহোদয়, উল্লেখিত কাজ সমূহের দূর্নীতির তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবী জানাচ্ছি। অন্যথায়, আগামী ২৯ জানুয়ারী/২০১৫ই আপনার রাঙ্গামাটি আগমন কালীন বোর্ড এর প্রধান কার্যালয়ের প্রধান ফটকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালন করা হবে।”

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন