জোরপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত না পাঠাতে রোহিঙ্গা নেতাদের আহ্বান

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও তাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক ফেরত না পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা নেতারা। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তাঁরা।

“নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও নাগরিকত্ব ছাড়া রোহিঙ্গাদের বার্মার গণহত্যা কবলিত অঞ্চলগুলোতে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না,” মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন বার্মা টাস্ক ফোর্স, আমেরিকার চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মুজাহিদ।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ১৯টি মুসলিম সংগঠনের সমন্বয়ে এই টাস্কফোর্সটি গঠিত।

মালেক মুজাহিদ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সাথে উত্তর রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য দেশটির বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের একজন। পরে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

এদিকে বাংলাদেশ কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক রাখাইনে পাঠানোর পক্ষে নয় বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “কোনো রোহিঙ্গাকেই জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হবে না। যারা স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরতে চান, তাঁদেরই প্রত্যাবাসন করা হবে।”

আবুল কালাম বলেন, “আমরাও চাই রোহিঙ্গাদের রাখাইনে নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত হোক। এ জন্য আসছে ১৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারকির জন্য গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।”

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “এখনো রাখাইনের যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানতে পারছি, এমনকি এখনো পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে যা শোনা যাচ্ছে; তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হয় না। সুতরাং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করি না।”

রোহিঙ্গাদের ফেরা সম্পূর্ণভাবে তাঁদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে। এখানে বল প্রয়োগের সুযোগ কোনো রাষ্ট্রের বা সরকারের নেই বলে মনে করেন তিনি।

“দেখুন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোনো শরণার্থীকেই আপনি জোরপূর্বক ফেরত পাঠাতে পারবেন না,” বলেন মিজানুর রহমান।

সামরিক নেতাদের সহযোগিতা প্রয়োজন

“মিয়ানমারের সাংবিধানিক নেতা অং সান সুচির সরকার সামরিক কর্মকর্তা ও দেশটির সাবেক নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া জাতিগত এবং ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত রাখাইনের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না,” বলেন ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক বর্মিজ আমেরিকান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য স লিং।

বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে তিনি বলেন, “আমার বোন তাঁর গ্রামে নিজের চোখে দেখেছে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাখাইন চরমপন্থীরা আগুন জ্বালিয়ে মানুষ হত্যা করছে। রোহিঙ্গা ভাষায় গ্রামটির নাম ভাসালা।”

গত বছর ২৪ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলা চালায় রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এর প্রতিক্রিয়ায় রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক পীড়নমূলক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। যদিও জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই এই অভিযানকে জাতিগত নিধন বলে দাবি করেছে।

নাগরিকত্ব আইন ‘পক্ষপাতদুষ্ট’

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে গত বছরের নভেম্বরে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এ চুক্তি অনুযায়ী যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায় তাঁদের রাখাইনে পূর্ববর্তী আবাসনের প্রমাণ দিতে হবে।

নাগরিকত্ব যোগ্যতা প্রমাণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাখাইনের নাগরিকদের এক ধরনের আইডি কার্ড দেওয়া শুরু করেছে মিয়ানমার।

কিন্তু এসব কার্ড প্রত্যাখ্যান করেছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়।

“মিয়ানমারে বসবাসকারী সকল রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের আলাদা সরকারি তালিকা রয়েছে। আমরা চাই ওই নথি অনুযায়ী মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নির্ধারণ করুক,” বলেন রোহিঙ্গা আমেরিকান সোসাইটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কিউ সোয় আং।

মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকৃত নয় এবং তাঁরা সরকারিভাবে স্বীকৃত দেশটির ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তও নয়।

এ নাগরিকত্ব আইনকে বৈষম্যমূলক ও পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে উল্লেখ করে কিউ সো আং বলেন, “এই আইন জনগণের সম্মতি ছাড়া জারি করা হয়েছে।”

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অধিকার ফেরত দিয়ে তাদের নিজে দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে মিয়ানমার সকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

আর যদি এটি করা হয়, তবে রাখাইন রাজ্যের সমস্যাগুলো দূর হয়ে যাবে বলে মনে করেন কিউ সো অং।

তথ্য যাচাইকরণ

আগামী ২২ জানুয়ারি প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবার পরিকল্পনা করছে মিয়ানমার। যদিও মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ এবং রোহিঙ্গা নেতারা এই হঠকারী প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে সতর্ক করছেন।

তাঁরা বলেছেন, বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই রাখাইনে তাদের পূর্ব অবস্থান প্রমাণের ডকুমেন্ট দেখাতে সক্ষম হবে না। কারণ নিরাপত্তা বাহিনীর অব্যাহত সহিংসতার মুখে তারা তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

এছাড়া ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে দমন ও বৈষম্যমূলক আচরণেরও মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তাঁরা।

“মিয়ানমার ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়নি,” বলেন কিউ সো অং।

তিনি বলেন, “চুক্তিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার তাদেরই ফেরত নেবে যারা এর আগে রাখাইনে বসবাস করার প্রমাণপত্র দিতে পারবে। কিন্তু বেশির ভাগ রোহিঙ্গার এ ধরনের কোনো নথি বা প্রমাণ নেই। কারণ মিয়ানমার সেনা এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তাঁরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।”

তবে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে চায়, তাঁদের আবাসস্থলের ঠিকানা যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজনীয় দলিলপত্র তাঁদের কাছে রয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সব দলিল এখনো তৈরির অপক্ষোয়।

“মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে তাদের অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য পরীক্ষা করে এবং তাদের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে,” বলেন কিউ সো অং।

তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকারকে রাখাইন রাজ্য নিয়ে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশগুলোও অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। যেখানে রাখাইন অঞ্চলে আরও সহিংসতা রোধ করার জন্য দেশের নাগরিকত্ব আইন পুর্নর্বিবেচনা এবং রোহিঙ্গাদের উপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলো বিলুপ্ত করার কথা বলা রয়েছে।

“আমি সম্পূর্ণভাবে তাঁর রিপোর্টের প্রস্তাবগুলোকে গ্রহণ করেছি,” তিনি বলেন।

কিউ সো অং বলেন, “যদি অং সান সুচির সরকার ও সেনাবাহিনী আনান কমিশনের পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

 

সূত্র: সঠিক সংবাদ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন