জিম্বাবুয়েকে হোয়াইট ওয়াশ করে বাংলাদেশের ইতিহাস

10455998_756012531172141_833164708854089130_n

ক্রীড়া ডেস্ক:

তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬১ রানে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক এই জয়ের মধ্য দিয়ে বছরের ব্যবধানে জিম্বাবুয়েকে দ্বিতীয়বার হোয়াইটওয়াশ করল টাইগাররা।

গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও সবগুলো ম্যাচ হেরে টাইগারদের কাছে বাংলাওয়াশ হয়েছিল সফরকারীরা।

২০০৫ সালে কেনিয়াকে দিয়ে হোয়াইটওয়াশ শুরু করে আজকেরটিসহ মোট ১১বার বিভিন্ন ক্রিকেট শক্তিকে হোয়াইটওয়াশ করেছে। গত জুনে ভারতের সাথে একটি হোয়াইট অল্পতে ফসকে যাওয়ায় এবছর পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়েকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

২৭৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই উইকেট হারালেও বাংলাওয়াশ এড়ানোর সম্ভাবনা জিইয়ে রেখছিল জিম্বাবুয়ে। ৬ষ্ঠ উইকেট পতনের পর জয়ের জন্য ৮৬ বলে ৯১ রান দরকার ছিল। হাতে চার উইকেট।

কিন্তু ৩৭তম ওভারে মাশরাফি বিন মুর্তজা চার নম্বরে নেমে উইকেটে টিকে উইলিয়ামসকে ফেরান। ৪১তম ওভারে এসে মুস্তাফিজ দ্বিতীয় বলে সিকান্দার রাজাকে ও তৃতীয় বলে লুক জঙ্গোকে ফেরান। এক ওভার বিরতি দিয়ে ৪৩তম ওভারে এসে টিনাশে পানিয়াঙ্গারা তুলে নিয়ে ৫ উইকেটের লক্ষ্য পূরণ করেন মুস্তাফিজ। ৪৪তম ওভারে এসে আরাফাত সানি শেষ ব্যাটসম্যান তাউরাই মুজারাবানিকে তুলে নিলে গুটিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে।

২৭৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই উইকেট হারায় জিম্বাবুয়ে। প্রথম ওভারেই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান চামু চিবাবাকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে বাংলাদেশে শিবিরে প্রথম সাফল্য এনে দেন পেসার মুস্তাফিজ। প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলে বোল্ড আউট হয়ে ফেরার আগে চিবাবা করেন ৪ রান।

এরপর ইনিংসের সপ্তম ওভারে আবারও আঘাত হানেন তরুণ পেসার মুস্তাফিজ। এবার তার শিকার আরেক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান চামু চিবাবা। দলীয় ৪৩ রানে নাসির হোসেনের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরার আগে তিনি করেন ১৭ রান।

ইনিংসের নবম ওভারে বোলিংয়ে এসেই নাসির হোসেন জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যান ক্রেইগ আরভিনকে সাজঘরে ফেরত পাঠালে দলীয় ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে জিম্বাবুয়ে। নবম ওভারের চতুর্থ বলে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফেরার আগে আরভিন করেন ২১ রান।

এরপর দলের হাল ধরেন অধিনায়ক এল্টন চিগুম্বুরা ও শ্যেন উইলিয়ামস। প্রাথমিক চাপ সামাল দিয়ে চতুর্থ উইকেট জুটিতে দলীয় সংগ্রহে ৮০ রান যোগ করেন তারা।

২৩তম ওভারে বোলিংয়ে এসে জুটি ভাঙ্গেন সাব্বির রহমান। ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠা জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক চিগুম্বুরাকে বোল্ড করে বাংলাদেশ শিবিরে স্বস্তি এনে দেন এই লেগ স্পিনার। দলীয় ১২৭ রানে সাব্বিরের ঘূর্ণিতে কাটা পড়ার আগে চিগুম্বুরা ৪৭ বলে ৪৫ রানের ইনিংস খেলেন।

চিগুম্বুরার বিদায়ের পর ম্যালকম ওয়ালারকে সঙ্গে নিয়ে আবারও প্রতিরোধ গড়েন উইলিয়ামস। পঞ্চম উইকেটে তারা দলীয় সংগ্রহে আরও ৫৯ রান যোগ করেন।

ইনিংসের ৩৬তম ওভারে বোলিংয়ে এসে ম্যালকম ওয়ালারকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে জুটি ভাঙ্গেন পেসার আল-আমিন হোসেন। দলীয় ১৮৬ রানে নাসির হোসেনের তালুবন্দি হয়ে ফেরার আগে ওয়ালার করেন ৩২ রান।

ওয়ালারের বিদায়ের পর উইলিয়ামসও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। পরের ওভারে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বোলিংয়ে এসে উইলিয়ামসকে সাজঘরে ফেরত পাঠান। দলীয় ১৮৮ রানে সাব্বিরের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে ৬৪ রান যোগ করেন তিনি।

এরপর ৪১তম ওভারে বোলিংয়ে এসে জিম্বাবুয়ের ইনিংসে আবারও জোড়া আঘাত হানেন পেসার মুস্তাফিজ। ওভারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে সিকান্দার রাজা ও লুক জংয়েকে সাজঘরে ফেরত পাঠান তিনি। রাজা ৯ ও জংয়ে ১১ রান করেন। তাদের বিদায়ে ৪১ ওভার শেষে সফরকারীদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ২১০ রান।

৪৩তম ওভারে এসে জিম্বাবুয়ে শিবিরে শেষ আঘাত হানেন মুস্তাফিজ। ওভার দ্বিতীয় বলে টিনাশে পানিয়াঙ্গারা ক্যাচ তুলে দিলে ৫ উইকেটের লক্ষ্য পূরণ হয় এ বছর জাতীয় দলে অভিষেক হওযা মুস্তাফিজের।

এরপর ৪৪তম ওভারে বোলিংয়ে এসে বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানি জিম্বাবুয়ের শেষ ব্যাটসম্যান তাউরাই মুজারাবানিকে তুলে নিলে ২১৫ রানেই গুটিয়ে যায় সফরকারীরা।

এর আগে বুধবার দুপুর ১টায় ঢাকার মিরপুর শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুরু হওয়া ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।

ব্যাট করতে নেমে উদ্বোধনী জুটিতেই ১৪৭ রান তুলে অধিনায়কের সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করেন দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। অর্ধশতক তুলে নিয়ে দু’জনেই আউট হন ৭৩ রান করে।

২৯.৩ ওভারে দলীয় ১৪৭ রানে ও ব্যক্তিগত ৭৩ রানে প্রথমে মাঠ ছাড়েন ইমরুল কায়েস। উইকেট থেকে বের হয়ে সিকান্দার রাজার বল তুলে মারতে গিয়ে স্টাম্পিং হয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কায়েসের এ সিরিজে এটি টানা দ্বিতীয় অর্ধশত।

৩৪.২ ওভারে দলীয় ১৭৩ রানে ক্রেমারের বলে একইভাবে উইকেট থেকে বের হয়ে তুলে মারতে গিয়ে স্টাম্পিং হন তামিম ইকবাল। তিনিও ব্যক্তিগহ ৭৩ রানে মাঠ ছাড়েন।

এরপর ৩৭.৫ বলে দলীয় ১৯০ রানে ওয়ালার বলে ক্রিজ থেকে বের হয়ে মারতে গিয়ে স্টাম্পিং হন মুশফিকুর। মুশফিক ২৫ বলে ২৮ রান করেন।

উদ্বোধনী জুটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে খুব দ্রুতই আউট হতে থাকে টাইগার ব্যাটসম্যানেরা। লিটন দাস ১৭, সাব্বির রহমান ১, নাসির হোসেন ০ রানে আউট হন। ৭ম উইকেট জুটিতে দলনায়ক মাশিরাফি ও মাহমুদুল্লাহ মুল্যবান ৩৭ রান যোগ করেন। মাশরাফি ১৬ রানে ও মাহমুদুল্লাহ ৫২ রান করে বিদায় নেন।

কিন্তু শেষ দিকে মাহমুদুল্লাহর ৪০ বলে ৫২ ও অধিনায়ক মাশরাফির ১১ বলে ১৬ রানের ইনিংসে ভর করে ২৭৬ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় টাইগাররা।

জিম্বাবুয়ের পক্ষে লুক জংয়ে ৫০ রানে ২টি ও গ্রায়েম ক্রেমার ৫৩ রানে ২টি উইকেট নেন।

মুস্তাফিজ সম্পর্কে অন্যরা যা বললো

জিম্বাবুয়ে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের জয়ের অন্যতম নায়ক মুস্তাফিজুর রহমান। মাত্র ৯ ওয়ানডেতেই ৩ বার ৫ উইকেট নিয়ে গড়েছেন নতুন রেকর্ড।

গত জুনে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডেতেই ৫ উইকেট নিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। পরের ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়ে গড়েছিলেন নতুন রেকর্ড। প্রথম ২ ওয়ানডেতে ১১ উইকেট ছিল না আর কারও। পরে টেস্ট অভিষেকেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে গড়েছিলেন আরেকটি রেকর্ড। ওয়ানডে ও টেস্ট, দুটিতেই অভিষেকে ম্যাচ সেরা হতে পারেননি ক্রিকেট ইতিহাসে আর কেউ।

৯টি ওয়ানডেতে ৩ বার ৫ উইকেট, আরও দুইবার ৩ উইকেট। বুধবার ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে দলের তরুণ পেসারকে নিয়ে মাশরাফির রসিকতা, “মুস্তাফিজ তো পণই করেছে যে ৩ উইকেট নেবে অথবা ৫ উইকেট নেবে। অন্য কিছু নয়!’

শুধু রসিকতাই নয়, মুস্তাফিজকে নিয়ে অধিনায়ক শোনালেন স্বপ্নের কথাও। “আমাদের শেষ তিনটি সিরিজে যেভাবে বোলিং করেছে মুস্তাফিজ, অনেক বড় অবদান আছে আমাদের সাফল্যে। আমি বিশ্বাস করি, অনেক বড় কোনো বোলারের রেকর্ড সে ভাঙবে।”

মুস্তাফিজকে ঠিকমতো পড়তে পারেন না তামিম ইকবালও। বুধবার তৃতীয় ওয়ানডে শেষে সংবাদ সম্মেলনে ওই ওপেনার জানালেন, নতুনদের জন্য কতটা দুর্বোধ্য মুস্তাফিজ।

“আমিও কিন্তু মুস্তাফিজের জন্য নতুন! এর আগে ওকে কোনো জায়গায় খেলিনি। নেটে ব্যাটিং করলে হয়ত দুই-তিনবার ওর বলে ব্যাটিং করেছি। ওকে যারা প্রথম খেলে, তাদের জন্যে ওকে খেলা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। হয়তো বা অনেক ব্যাটিং করলে বা অনেকদিন খেললে ওর সম্পর্কে একটা ধারণা হবে।”

মুস্তাফিজ বোলিংয়ে আসলে সব সময়ই কিছু না কিছু হওয়ার রোমাঞ্চ থাকে, জানালেন তামিম।

“ও যখন বোলিংয়ে আসে, আমরা সব সময় অনুভব করি যে কিছু একটা হবে। এমন একজন বোলারে ঘাটতি ছিল আমাদের এত দিন। যে কিনা শুরুতে-শেষে- মাঝে, যে কোনো সময় উইকেট এনে দেবে। গত তিন সিরিজের ওর যা সাফল্য, তাতে আমাদের মূল নায়ক মুস্তাফিজই।”

সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৭৬/৯ (তামিম ৭৩, ইমরুল ৭৩, মাহমুদুল্লাহ ৫২; লুক জংয়ে ৫০/২, গ্রায়েম ক্রেমার ৫৩/২)।

জিম্বাবুয়ে: ৪৩.৩ ওভারে ২১৫/১০ (উইলিয়ামস ৬৪, চিগুম্বুরা ৪৫, ওয়ালার ৩২; মুস্তাফিজ ৩৪/৫)।

ফল: বাংলাদেশ ৬২ রানে জয়ী,

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: তামিম ইকবাল,

ম্যান অব দ্য সিরিজ: মুশফিকুর রহিম

বাংলাদেশ দল: মাশরাফি বিন মর্তুজা (অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, লিটন কুমার দাস, সাব্বির রহমান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন, আরাফাত সানি, মুস্তাফিজুর রহমান ও আল আমিন হোসেন।

জিম্বাবুয়ে দল: এলটন চিগুম্বুরা (অধিনায়ক), সিকান্দার রাজা, রেগিস চাকাভা, চামু চিবাবা, ক্রেইগ আরভিন, রিচমন্ড মুতুম্বামি, এমএন ওয়ালার, এজি ক্রিমার, শন উইলিয়ামস, লুক জঙ্গো, টিনাশে পানিয়াঙ্গারা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন