রাজনৈতিক ডামাডোলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভেঙে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার তৎপরতা

মেহেদী হাসান পলাশ

সমগ্র দেশ যখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রীক জাতীয় রাজনীতি নিয়ে উত্তাল ঠিক সেই মূহুর্তে বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূ-খণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের উপর প্রবল আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের একটি চক্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে এই চক্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশে থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের জন্য তৎপরতা ও  প্রপাগাণ্ডা প্রবলতর করেছে। এদের ঔদ্ধত্য এতো বেপরোয়া হয়েছে যে, আজ ১০ নভেম্বর সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। Ministry of National Security, Government of Jummaland নামক ফেসবুক গ্রুপ থেকে এ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ছাড়াও govt republic of jummalamd, UNIVERSITY OF JUMMALAND, GOVERNMENT OF JUMMALAND, Ministry of Foreign Affairs, Jummaland জাতীয় বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপ থেকে এই কর্মসূচী ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। ঘোষণা অনুযায়ী এদিন তাদের অবিসংবাদিত নেতা এম এন লারমার হত্যা দিবস হওয়ায় জাতীয় শোক দিবস হিসাবে জুম্মল্যান্ডের পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলন করা হবে।

কর্মসূচীতে বলা হচ্ছে, “On 10th November, Jummaland national condolence day & public holy day in whole Jummaland & aboard of Embassy of the Republic of Jummaland & Ministry of Home Affairs, declared by Govt.of Jummaland. those day (10th Nov.) Jummaland national flag half down raising all Jummaland & aboard.Thanks.”

শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে জুম্মল্যান্ড নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে জুম্মল্যান্ডের পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ উপলক্ষে জুম্মল্যান্ডের একটি পতাকার ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে এসকল গ্রুপে।

চুড়ান্তভাবে জুম্মল্যান্ড ন্যাশনাল পার্লামেন্ট অনুমোদিত এই পতাকা জুম্মল্যান্ড তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল পাহাড়ী আঞ্চলিক সংগঠনগুলো এই পতাকা গ্রহণ করেছে বলে দাবী করা হয়েছে। ঠিকানা দেয়া হয়েছে, Republic of Jummaland, Rangamati-450005, Email:[email protected]. CHT National Modern Flag Making Commission collaborated CHT International Intelligent Agency Peace Group for European Union এর সহায়তায় ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল এ পতাকা উন্মোচন করা হয়।

চার রঙের চার কলাম বিশিষ্ট এই পতাকার মাঝখানে একটি তারকা খচির এ পতাকা তৈরি করেছে জুম্মল্যান্ড ন্যাশনাল ফ্লাগ মেকিং কমিশন। এ পতাকার ব্যাখাও দেয়া হয়েছে। পতাকার চার কলামের প্রথম কলামের রঙ সাদা। এর অর্থ জুম্মল্যান্ডের সাধারণ জীবনযাপন ও খাঁটি মনের ১৩টি উপজাতি যারা বিশ্বাস করে সকলের সমান অধিকার ও ক্ষমতা ভোগের অধিকার রয়েছে। দ্বিতীয় রঙ হচ্ছে লাল। এর অর্থ হচ্ছে, জুম্ম জাতির দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম।  এই সংগ্রামে হাজার হাজার জুম্ম বীর মারা গেছেন। তাদের রক্তের রঙ লাল যা এই পতাকায় বিধৃত হয়েছেন। তৃতীয় কলামের রঙ হচ্ছে সবুজ। এই সবুজ অর্থ পাহাড়ের বৃক্ষ ও সবুজ প্রকৃতি। লাল ও সবুজের মাঝে অবস্থিত তারকা অর্থ পৃথিবী এই তারকার মাধ্যমে জুম্ম জনগনের আশা ও আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাবে।মাঝখানে লাল ও সবুজের অর্থ এটা তিন ঐতিহ্যবাহী রাজার প্রতীক। চতুর্থ কলামের রঙ নীল অর্থ পাহাড়ী নদী। পাহাড়ী নদীতে বহমান পানির রঙ নীল।

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রকাশ্যে স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা বললেও পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনীতির সাথে জড়িত একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনে তৎপর রয়েছে। দেশে ও দেশের বাইরে বসে এই চক্রটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন শক্তির সাথে যোগাসাজসে এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গোষ্ঠীর ব্যাপক ও সংঘবদ্ধ তৎপরতা চোখে পড়ে। তারা জুম্মল্যান্ডের মানচিত্র, সরকারী মনোগ্রাম, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জুম্মল্যান্ডের সশস্ত্র বাহিনী তথা জুম্ম লিবারেশন আর্মি, জুম্মল্যান্ডের মুদ্রা, রেডিও ইত্যাদির ছবি প্রকাশ করে ব্যাপক প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে।

তাদের এই প্রচারণার মূল টার্গেট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাঙালী।  পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও তা সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের বিরুদ্ধে, জাতীয় চেতনার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণা ছড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পাহাড়ীদের মধ্যে দেশপ্রেমহীনতা ও আনুগত্যহীনতা সৃষ্টি করে কল্পিত জুম্মল্যান্ড রাষ্ট্রের প্রতি প্রেম ও আনুগত্য সৃষ্টি করা। তাদের এই বিদ্বেষূলক ও ঘৃণাত্মক প্রচারণার ফলে তরুণ ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে।

অনুন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মল্যান্ডের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছিল আঞ্চলিক সংগঠনের পক্ষ থেকে অত্যন্ত । সে উপলক্ষে অতি গোপনীয়তার সাথে জুম্মল্যান্ডের কিছু পতাকা তৈরি করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন আস্তানায় পাঠানো হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্যাম্প ও দলীয় কার্যালয়ে এই পতাকা উত্তোলন করে তার ভিডিও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে বলা হবে যে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পাতাকা তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতার কারণে জুম্মল্যান্ডের পতাকা তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল ঘোষণাকারীরা। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপর থাকলেও স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পতাকা উত্তোলনের মতো কর্মসূচী আর নেয়নি তারা।

তবে গত বছর, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ভারতের নয়াদিল্লীতে ‘মার্টিয়ার ডে’ শিরোনামে একটি শোকসভা আয়োজন করা হয়। ওই সভার ব্যানারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তথাকথিত ‘জুম্মল্যান্ড’ এর মানচিত্র প্রকাশ করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে কথিত জুম্মল্যান্ডের স্বঘোষিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী করুণালংকার ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের চলতি বছরের মার্চে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি সেমিনার আয়োজনের তথ্য রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য দেওয়া হয় বলে একটি সরকারি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।

মূলত সেই ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত  ও মিয়ানমারের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের বেশিরভাগই।

স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকে বাংলাদেশের রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান রেজিমেন্টের বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ভারত ভাগের ২ দিন পর রাঙামাটি থেকে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে। সেই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ড নিয়ে। সে হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি পাকিস্তানভুক্ত না হতো তাহলে তা বাংলাদেশেও অন্তর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ হতো। ভারত ভাগের ৭১ বছর পর হলেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক সংগঠন ও তাদের শাখা সংগঠনগুলো পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের রাঙামাটি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভারতীয় পতাকা নামিয়ে দেয়ার দিন ১৭ আগস্টকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন দিবসরূপে পালন করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর থেকে ভারতে অবস্থিত চাকমা উপজাতিরা এদিনকে ব্লাক ডে বা কালো দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ ও এর বিভিন্ন শাখা সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, যুব ফ্রন্ট, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এর নেতৃবৃন্দ প্রতিবছর ১৭ আগস্টকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন দিবস পালন করে থাকে।

২০ আগস্ট ২০১৬ তারিখে সিএইচটিনিউজ.কমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়: “পাকিস্তান কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসনের ৬৯তম বার্ষিকী উপলক্ষে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), ঢাকা শাখার উদ্যোগে ১৯ আগস্ট শুক্রবার বিকাল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক কার্জন হল মাঠে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে’’।

উক্ত আলোচনা সভায় ইউপিডিএফ নেতা নতুন কুমার চাকমা তাঁর বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন দিবসের বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, ‘দেশ ভাগের সময় তৎকালীন জনসমিতির সাধারণ সম্পাদক স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী রাঙামাটিতে ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাক-এর পরিবর্তে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন ইংরেজ জেলা প্রশাসক কর্ণেল জি. এল. হাইড নিজেও উক্ত পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পতাকায় স্যালুট করেন। পরে কর্ণেল হাইড নিজের দপ্তরেও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। অন্যদিকে বন্দরবান সদরে বোমাং রাজ পরিবারের উদ্যোগে উত্তোলিত হয় বার্মার পতাকা।

ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হওয়ার পর ১৭ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশটি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দিয়ে ম্যাপে প্রদর্শিত হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পরবর্তীতে ২০ আগস্ট পাকিস্তানের বালুচ রেজিমেন্ট এক সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে নামিয়ে দেয় স্থানীয় অধিবাসীদের উত্তোলিত পতাকা। সূচনা হয় আগ্রাসী অপশক্তির দখলদারিত্বের নতুন ইতিহাস। এই দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের পর পাকিস্তানি শাসকরা যে শোষণ-নির্যাতনের জোয়াল পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল তা আজ ৬৯ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও জারি রয়েছে।’

সিএইচটিনিউজের ২০ আগস্ট ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ‘নব্য বেলুচ রেজিমেন্ট সম্পর্কে সজাগ হোন! ধর্মের লেবাসধারী পাকিস্তানি চরদের প্রতিরোধ করুন’ এই শ্লোগানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তান আগ্রাসনের ৬৯ বছর উপলক্ষে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন জেলা কমিটির উদ্যোগে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ২০ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের জন্য একটি অভিশপ্ত দিন বা ‘কাল দিবস’। ১৯৪৭ সালের এই দিনে হানাদার বাহিনী ‘বেলুচ রেজিমেন্ট’ সশস্ত্র আগ্রাসনের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা গুঁড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

২০১৬ সালের ২৪-২৫ মার্চ আসামের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার প্রথম জাতীয় অধিবেশনে এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে সমগ্র ভারতের চাকমা জনগোষ্ঠী প্রতি বছর ১৭ আগস্টকে ব্লাক ডে পালনের আহ্বান ঘোষণা দেন। সে মোতাবেক ১৭ আগস্ট ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো বিশেষ করে আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল এবং দিল্লী, বেঙ্গালুরুসহ যেসব রাজ্যে চাকমা জনগোষ্ঠী বসবাস করে তারা একসাথে ব্লাক ডে বা কালো দিবস পালন করে।

সেভেন সিস্টার্স থেকে প্রকাশিত গণমাধ্যমসহ ভারতের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে ফলাও করে চাকমাদের এই ব্লাক ডে পালনের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সংস্থার ত্রিপুরা কমিটির পক্ষ থেকে গত ১৭ আগস্ট) আগরতলায় প্রেস ক্লাবের সামনে কালো দিবস পালনের অঙ্গ হিসেবে একটি ধর্ণা কর্মসূচী নেওয়া হয়। এখানে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এ উপলক্ষে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে চাকমারা।

পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়,‘বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলকে নিজেদের মূল ভূখণ্ড বলেই মনে করে থাকে চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষজন। কিন্তু তাদের জোর করে সেই ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধেই তীব্র প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণ করে ‘চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ আহ্বান জানায় ‘ব্লাক ডে’ পালনের।

জুম্মল্যান্ড ষড়যন্ত্রের এখানেই শেষ নয়। জুম্মল্যান্ড বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের হঠাৎ করেই আদিবাসী দাবী করতে শুরু করে। কেননা, আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে আইএলও কনভেনশন-১৬৯ এবং জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টার-২০০৭ অনুযায়ী জুম্মল্যান্ডের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন আদিবাসীর দাবি এমন একটা জনগোষ্ঠী থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যারা ৪২ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। কৌশলগত কারণে তারা স্বায়ত্তশাসনের কথা যতোটা উচ্চকিত করে স্বাধীনতার কথা ততোটা নয়। ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষই রাষ্ট্রবিরোধী এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও রহস্যময় আবরণে সযত্নে ঢেকে রেখেছে দেশবিরোধী এই দুষ্টুক্ষত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে করুণালঙ্কার ভান্তে নামে জেএসএসের এক শীর্ষ নেতার ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশধারী এই ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় তার কর্মতৎপরতার কথা বিস্তারিতভাবে বলেছেন। অডিও-ভিডিও’র এই স্বাক্ষাৎকারে ভান্তে আরো জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্র তাদের হাতে রয়েছে। এখন তিনি শুধু ৫ লক্ষ গোলাবারুদ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।

এই পরিমাণ গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে স্বাধীন জুম্মল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ভিক্ষু সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যেমন পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা অর্জনের উদাহরণ তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী তরুণ প্রজন্মকে তার সাথে একাত্ম হতে আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আন্তর্জাতিক শক্তিকে তিনি পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাবেন বলেও জানিয়েছেন।

পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে যখনেই কোনো ক্রান্তিকাল বা সংকট উপস্থিত হয় অথবা সরকার যখন কোনো না কোনো কারণে দূর্বল অবস্থানে থাকে তখনই পাহাড়ের এই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিগুলো তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা যেকোনো সঙ্কটের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সে বিবেচনাতেই এই রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা নস্যাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

 লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ ও পার্বত্যনিউজ.কম, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন


পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জুম্মল্যান্ড, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদ
Facebook Comment

One Reply to “রাজনৈতিক ডামাডোলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভেঙে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার তৎপরতা”

  1. সরকারের উচিত সব কিছু খতিয়ে দেখা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা,,,আমাদের দেশের কিছু অংশ দখলের সড়যন্ত্র চলছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন