চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজনই সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বেশি জড়িয়ে পড়েছে

hill-politics04-edited

আতিক রহমান পূর্ণিয়া, বান্দরবান থেকে ফিরে:

জুমের চাল, পাহাড়ের বাঁশকোড়ল, লতাপাতা আর ফলমূল খেয়ে দিন চলে পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। এ অর্থে তাদের শান্তিতে বসবাস করার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র পুরোপুরি উল্টো। একদিকে জেএসএস, ইউপিডিএফ আবার কখনও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, অন্যদিকে তুলনামূলক সমতলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানাটানিতে বান্দরবানের থানচির এংলাপাড়ার মানুষ নিঃশেষ হচ্ছে। নিজেদের জীবনে নগদ অর্থের প্রয়োজন না হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপকে চাঁদা দিতেই তাদের অনেক সময় দৌড়াতে হয় টাকার খোঁজে। রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও তারা যেন দূরে নন।

বান্দরবানের থানচি পেরিয়ে তিন্দু বাজার। এরপর রেমাক্রিপাড়া পেরিয়ে গেলে এংলাপাড়া। যেখানে সমতলের সাধারণের (বাঙালি) যাওয়ার অনুমতি নেই। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা সমর্থক নন।

অন্যমিডিয়া

গত মাসের শেষ দিকে এই প্রতিবেদক এংলাপাড়া ও তার আশেপাশের মানুষজনের সঙ্গে তাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গেলে তারা যেন মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেন। আক্ষরিক অর্থেই তারা বাংলা বোঝেন না এমন ভান করেন।

পরে নানাভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ের একদিকে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) আবার কখনও কখনও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীগোষ্ঠী, অন্যদিকে তুলনামূলক জেলা ও উপজেলা সদরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চাপে পড়ে এংলাপাড়ার মানুষ পিষ্ট হচ্ছে। নিজেদের জীবনে নগদ অর্থের তেমন প্রয়োজন না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপকে চাঁদা দিতে তাদের টাকার খোঁজে বের হতে হয়।


এই সিরিজের প্রথম কিস্তি পড়ুন নিচের লিংকে:

  1. ♦ আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করতে জেএসএসের প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র ক্যাডার তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করেছে
  2. ♦ আ’লীগ ঠেকাতে জেএসএস-ইউপিডিএফ একাট্টা
  3. পাহাড়ে আরাকান আর্মির উৎপাত

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এংলাপাড়ার যে কয়জন মানুষ মাসে এক-দু্ইবার জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা কোনো কিছু বিক্রি করতে বাজারে যান তাদের প্রত্যেকের কাছে একটি করে জেএসএস ও ইউপিডেএফের টোকেন থাকে। ডাব, কলা, মুরগী, বাঁশ- এমন প্রত্যেক পণ্যের জন্য এক এক ধরনের চাঁদার রেট। তা দুই টাকা থেকে শুরু করে ১৫ টাকা পর্যন্ত। এই চাঁদা একবার বাদ না দিলে পড়তে হয় হয়রানি বা নির্যাতনের মুখে। আবার এই দুই সংগঠনের ক্যাডারদের জন্য দরকারে পাহাড়ে খাবার ও মোবাইল ফোন, মোবাইলে রিচার্জের টাকা পৌঁছাতে হয়।

এটা শুধু এংলাপাড়ার চিত্র নয়। সরেজমিন বান্দরবান জেলা সদরসহ বিভিন্ন দূর্গম এলাকা ঘুরে এবং রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধির সহযোগিতায় তথ্য নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের এমন জিম্মি অবস্থারই চিত্র পাওয়া যায়। অন্যদিকে সেটেলার বলে পরিচিত বাঙালিদের একাংশ নিজেদের মধ্যে আলাদা বলয় তৈরি করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছাকাছি গুচ্ছবদ্ধ থাকতেই পছন্দ করছে। কারণ হিসেবে জানা যায়, পাহাড়ে বিবাদমান জেএসএস-ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা অন্যদিকে নিরাপত্তার কথা বলে ১৯৮৬-৮৮ সালের দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিল।

রাজনীতির এই মারপ্যাঁচে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ ও বাঙালিদের মধ্যে স্বার্থগত নানা বিরোধও দিন দিন বাড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা ইস্যুতে ভেদাভেদ বাড়ার পেছনে অভিযোগের তীর আওয়ামী লীগের দিকেই বেশি।

জেএসএসের মুখপাত্র সজিব চাকমা অভিযোগ করেন, সরকারের একটি মহল বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে ‘আদিবাসীদের’ মধ্যে বিরোধ তৈরি করছে। ত্রিপুরা এবং মারমাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিকে হাত করে সরকার তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে বলেও সজিব চাকমার অভিযোগ।

যদিও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্য সম্প্রদায়গুলোর অভিযোগ, চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজনই সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বেশি জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জেএসএসের উগ্রপন্থি অংশ ও ইউপিডিএফের উপরের সারির নেতাদের মধ্যে চাকমাদের নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকায় এই অভিযোগ আওয়ামী লীগসহ অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বেশি করে উপস্থাপন করেন।

অন্যদিকে, পার্বত্য তিন জেলারই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কৌশলে বিভক্তি তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের একজন খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম বলেন, বহুধারায় বিভক্ত জেএসএস বা ইউপিডিএফের কাছে এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কোনো ভেদাভেদ নাই। যাকেই নিজেদের স্বার্থের বাধা মনে করে তাকেই এই দুই সংগঠন টার্গেট করে বলে জাহিদুল আলমের অভিযোগ।

উল্লেখ্য, ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে আসলেও জেএসএস গত প্রায় দেড় যুগ ধরেই বলে আসছে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই পারে পাহাড়ের রাজনীতির আগুন নেভাতে। আর আওয়ামী লীগের তিন টার্মের ক্ষমতায় থাকার সময় বরাবরেই দলটির নীতিনির্ধারকরা বলে আসছেন শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যতটুকু বাকি আছে তা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন।

সূত্র: পরিবর্তন.কম

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন