চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন প্রকল্প: খুলে যাবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার

chakaria-pic-26-09

চকরিয়া প্রতিনিধি:

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন প্রকল্প অবশেষে আলোর মুখ দেখছে। এতে কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। কয়েকবছর আগেও এখানকার মানুষের মাঝে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিলেও প্রতিক্ষিত এই রেল লাইন নির্মাণকাজের কয়েকধাপ এগিয়ে যাওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছে তারা। ডুয়েল গেজের রেল লাইনটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে পাল্টে যাবে এখানকার অর্থনৈতিক চিত্র, আমূল পরিবর্তন ঘটবে যোগাযোগ ব্যবস্থার। এদিকে রেল লাইন স্থাপনের জন্য তৈরিকৃত নকশায় কক্সবাজারের চকরিয়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বহু ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে এসব স্থাপনা সরিয়ে নিতে রেল লাইন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন ধরণের নোটিশ পাননি এবং জমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কি-না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চট্টগ্রাম জেলায় ২৮০ একর এবং কক্সবাজার জেলায় ৯৯৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দাবিকৃত ৩৯১ কোটি টাকার মধ্যে ৩১২ কোটি টাকা ইতিমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। গাছপালা এবং বাড়িঘর, বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহনের জন্য টাকা দাবি করেছে ৩১৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের শুরুতে মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি নির্দেশ দেন মিটার গেজ নয়-ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে, যাতে মিটার গেজ ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের ট্রেন চলাচল করতে পারে। ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেওয়ার পর ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতিক্ষিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন। কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল রেল (কেনারাল), স্ম্যক ইন্টারন্যাশনাল পিটিওয়াই লি. অস্ট্রেলিয়া (এসএমইসি), ডিবি ইন্টারন্যাশনাল জিএমএসএইচ জার্মানী ও এসিই কনসালট্যান্ট লি. নামের এই চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ কাজ করে। ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১৮৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি ও কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালের সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা বাদ দিয়ে নতুন করে জরিপ কাজ করতে হয়েছে। এ জরিপ কাজও গত জুলাই মাসে সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে দোহাজারী হতে চকরিয়া-রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু হতে ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারসহ ১২৮ কি.মি নতুন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হবে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন প্রকল্পের সহকারী পরিচালক আবদুল গফুর মজুমদার জানান, ভূমি অধিগ্রহনের কাজ সম্পন্ন হলেই রেলপথ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দিতে প্রস্তুত আছে এশিয়ান ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। শুরুতে মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে নির্দেশ দেন মিটার গেজ নয়, ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে, যাতে সব ধরনের ট্রেন চলাচল করতে পারে। ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ এর আওতাভূক্ত ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের ঝিলংজায় প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সূত্র জানায়, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার পাশপাশি বনজ ও কৃষি পণ্যসামগ্রী সহজে পরিবহনের সুবিধার্থে এই রেল লাইন স্থাপনের চেষ্টা বৃটিশ আমল থেকেই অব্যাহত ছিল।

প্রকল্পে যা রয়েছে:

দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিমি: এবং রামু হাতে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারসহ ১২৮ কিলোমিটার নতুন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ। পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলের নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষি দ্রব্যাদি পরিবহন এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোর মিসিং লিংক নির্মাণ। দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কি.মি, রামু থেকে কক্সবাজার ১২কি.মি এবং রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ কি.মি রেলপথ নির্মাণের কথা রয়েছে। আর ১২৮ কি.মি এ রেলপথে স্টেশনের সংখ্যা থাকছে ৯টি। স্টেশনগুলো হলো সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সাহারবিলের রামপুর, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার, উখিয়া এবং ঘুনধুম। এতে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম থাকবে ৯টি, ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থাকবে ৯টি। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর উপর নির্মাণ করা হবে ব্রিজ। এাড়াও ৪৩টি মাইনর ব্রিজ, ২০১টি কালভার্ট, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় একটি ফ্লাইওভার, ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং এবং রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবিত প্রকল্পে।

চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০০১ সালের ভূমি জরিপের সময় চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট এলাকায় মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালের মাঝখান দিয়ে রেললাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বাঁধ সাধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে চীনের সাথে চুক্তি হলে এডিবি চীনের অর্থায়নে চারটি সংস্থার সমন্বয়ে দ্বিতীয়বার জরিপ করা হয়। এই জরিপে মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতাল এলাকা রেললাইন থেকে বাদ দিয়ে নকশা পরিবর্তন করা হয়।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘রেল লাইন স্থাপনের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে রেল লাইন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসন থেকে যখনই জরিপসহ যে কোন বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে, তখনই সহায়তা দেওয়া হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে হারবাং ইউনিয়নের বড়ুয়া পাড়া এবং চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়সহ রেল লাইনের নকশায় যেসব স্থাপনা পড়েছে তা সরেজমিনে একাধিকবার পরিদর্শন করা হয়েছে। স্থাপনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকসহ নানা তৎপরতা চালানো হয়েছে। এ সময় বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা তাদের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য আগ্রহও দেখিয়েছেন।’

চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘কক্সবাজারবাসীর শতবছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে প্রতিক্ষিত রেল লাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে। রূপকল্প ২০২১ এর আওতায় দোহাজারি-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন প্রকল্পটি ইতিমধ্যে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে কক্সবাজারবাসীর। সেই অপেক্ষার প্রহরণ গুনছি আমরা।’

জাফর আলম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রতিক্ষিত এই রেলপথ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। রেলপথ নির্মাণের জন্য তৈরিকৃত নকশায় বাড়িঘর, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যেসব স্থাপনা পড়েছে তাদের ক্ষতিপূরণসহ ভূমি অধিগ্রহন বাবদ উপযুক্ত মূল্য পরিশোধের জন্যও বরাদ্দ রেখেছেন। তাই এনিয়ে কারো দুশ্চিন্তায় ভোগার কারণ নেই।’

প্রস্তাবিত নকশায় চকরিয়ার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পালাকাটা কুসুমকলি শিক্ষা নিকেতনের মাঝখান দিয়ে রেল লাইন স্থাপন করা হবে। এ কারণে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ভেঙে ফেলতে হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর মাসে রেল লাইন কর্তৃপক্ষের ৫ জন কর্মকর্তা এলাকা পরিদর্শনে আসেন। এখনো পর্যন্ত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কোন ধরণের নোটিশ দেওয়া হয়নি। তবে কয়েকদিন আগে চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলাম হঠাৎ পরিদর্শনে এসে নতুন করে বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণের তাগাদা দেন।’

এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, ‘পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয় এবং কুসুম কলি শিক্ষা নিকেতন প্রস্তাবিত রেল লাইনের নকশায় পড়েছে। তা ভেঙে ফেলা এবং নতুন করে ভবন নির্মাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, ভূমি অধিগ্রহনে জটিলতা, অর্থ সংকট, মিটার গেজ-ব্রড গেজ বিতর্ক, হাতির অভয়ারণ্যসহ নানা জটিলতার কারণে পাঁচ বছর ধরে প্রকল্পটি স্থবির হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু সংশোধন এনে একনেক সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। সর্বশেষ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ফলে ৬  বছর পর দ্বিতীয় দফায় প্রকল্প অনুমোদনে ব্যায় বাড়ল ৮৭৪ শতাংশ। এই ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দেবে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হবে বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে বছরে প্রায় ২০ লাখ যাত্রী রেলে চলাচলের সুযোগ পাবেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন