চকরিয়া সুন্দরবনে, ফিরে এসেছে প্যারাবন প্রাচীন ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা

চকরিয়া প্রতিনিধি:

উপমহাদেশের মধ্যে যে কয়টি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন রয়েছে তন্মধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবন ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। তিন যুগ আগেও এ সুন্দরবন প্রাকৃতিক অপরূপে ভরপুর ছিল। এ বনে ২০ প্রজাতির গাছ-গাছালি ও বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখিতে ছিল সমাগম।

সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৌন্দর্যের এই বনকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে মানুষরুপী কিছু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তারা। প্রাচীনত্ব বিবেচনায় “চকরিয়ার সুন্দরবন” ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে। মানুষরূপী ভূমি দস্যুরা রাক্ষুসের মতো গিলে ফেলেছে সুষ্টিকর্তার প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের ভরপুর এ সুন্দরবনকে।নিঃশেষ করে দিয়েছে সুন্দরবনের নানা রকমের গাছ-গাছালি।

শুধুমাত্র প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চট্রগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নস্থ মইগ্যারমার ছড়া এলাকায় কালের স্বাক্ষী হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে ৪-৫টি সুন্দরী গাছ। কিন্তু মানুষরূপী কিছু ভূমিদস্যু ও বনখেকোদের কারণে তাও আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। প্রাচীন এ ঐতিহ্যকে বাঁচাতে এখানে রোপন করা গাছ গুলো হতে সংগৃহীত বীজ উত্তোলন করা এ সব সুন্দরী গাছের চারা।এ গাছ গুলিকে বাঁচতে দিন এবং সুন্দরবনের শেষ চিহ্নকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে,  উপমহাদেশের বিখ্যাত খুলনা ও তৎসংলগ্ন সুন্দরবনের সাথে চকরিয়ার সুন্দবনের বৈশিষ্টগত কোন পার্থক্য নেই। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, চকরিয়ার ঐতিহ্যবাহী সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপমতা এখন আর নেই। চিংড়ি ও লবণ মাঠ সবকিছু তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে সুন্দরবনের সুন্দুরী, গেওয়াসহ নানা প্রজাতির সবুজ আবাসস্থল।

এখন সেখানে শুধু দেখা মিলবে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠের। চকরিয়া সুন্দরবনকে ১৯০৩ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই সময় সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৪৫হাজার ৫শত একর। পরবর্তীতে চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় কিছু কৃষি ভূমি হিসেবে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এতে চকরিয়া সুন্দরবনের আয়তন কমে যায়।

এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে চকরিয়া সুন্দরবনের ধ্বংসযজ্ঞের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮০সালে এ বনের আয়তন কমে ২১ হাজার একরের মধ্যে নেমে আসে। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের চাপে এই সুন্দরবন (প্যারাবন) ভুমি মন্ত্রাণালয় রপ্তানীমুখী চিংড়ি চাষের আওতায় আনতে বাধ্য হয়।

ফলে ১৯৮০সনে সরকারি পৃষ্টপোষকতায় এ বনে চিংড়ি ঘের তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৮২সনে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের ঋনের সহয়তায় একশটি চিংড়ি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়, যার প্রত্যেকটির আয়তন ছিল ১১ একর করে। এবং একই সাথে চিংড়ি খামার রক্ষায় ১৮ কিলোমিটার রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করা হয়। এই নিধনযজ্ঞের মহড়ায় সর্বশেষ যোগ হয় প্রকৃতির আঘাত।

১৯৯১ সালের ২৯এপ্রিল রাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন আঘাত হানে পুরো উপকূলে। কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় বিরানভূমিতে। ব্যাপক জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি অস্তিত্ব হারায় চকরিয়া সুন্দরবন।

এবার সম্ভবনার খবর- চকরিয়ার উপকূল তথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবনে নতুন করে বাইন, কেওড়া, গেওয়াসহ লবণসহিষ্ণু প্যারাবন সৃজনের উদ্যোগ নেয় জাপানভিত্তিক পরিবেশবাদী সংস্থা‘দ্য অর্গানাইজেশন ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্পিরিচুয়াল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাডভান্সমেন্ট(ওআইএসসিএ)ইন্টারন্যাশনাল।এই উদ্যোগের শুরুটা হয়েছিল ১৯৯২সালে।

পরবর্তী সময়ে ওই সংস্থার ব্যানারে জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর বাংলাদেশে এসে সরাসরি চকরিয়া সুন্দরবনের জেগে ওঠা চরে প্যারাবন সৃজন শুরু করেন। অব্যবহিত এই সময়ের মধ্যে জাপানি সংস্থাটি কম করে হলেও ২০ লাখের মতো চারা রোপণ করে। এর মধ্যে বয়স অনুপাতে বেশ কিছু প্যারাবন কোথাও ১০ মিটার, ১৫ মিটার, এমনকি ২০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় দাঁড়িয়ে গেছে। হারানো সৌন্দর্য ফিরে পেতে শুরু করেছে চকরিয়া সুন্দরবন। আর সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইতিমধ্যে অনেকেই দলবদ্ধভাবে ছুটে যাচ্ছে এই বনে।

সরেজমিনে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে পরিদর্শনে গিয়ে দেখাগেছে, চকরিয়া ওমহেশখালীর মাঝখানে সাগর মোহনায় বিদ্যমান চকরিয়া সুন্দরবনের নয়নাভিরাম দৃশ্য। জাপানিদের সৃজিত প্যারাবনে মাতামুহুরী নদীর মোহনা ও ততসংলগ্ন অসংখ্য

ছড়াখালের দুই ধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। সেই বনের সঙ্গে মিতালি করছে নীল আকাশ আর সাগরের নীলাভ জলরাশি। ছোটাছুটি করছে অতিথি পাখি, সাদা বকসহ নানা জলজ প্রাণী।

ওআইএসসিএ ইন্টারন্যাশনাল, চকরিয়ার ব্যবস্থাপক হামিদুল হক মানিক পার্বত্যনিউজকে জানান, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জের আওতাধীন প্রায় ২৮ হাজার একর প্যারাবন ছিল। মূলত আশির দশকের শুরুর দিকে এই প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয় চিংড়ির ঘের। আর এক শ্রেণির ঘের ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্যে ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায় উপকূলীয় মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহৃত চকরিয়া সুন্দরবন।

একানব্বইয়ে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায় কক্সবাজার উপকূলে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির খবর। এরপর আইডিবি জাপান ম্যানগ্রোভ রি-ফরেস্ট্রেশন প্রকল্পের আওতায় ১৯৯২ সাল থেকে প্যারাবন সৃজনে কাজ শুরু করে ওআইএসসিএ ইন্টারন্যাশনাল।

সর্বশেষ ২০১৪সাল পর্যন্ত চকরিয়া সুন্দরবনের রামপুর, চরণদ্বীপ, চিলখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী মৌজাসহ আশপাশের অন্তত এক হাজার একর বিশিষ্ট উপকূল এবং সাগর-তীরবর্তী ও সুন্দরবনের জেগে ওঠা চরে প্যারাবন সৃজন করা হয়। প্রতি একরে দুই হাজার করে এ পর্যন্ত অন্তত ২০ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, সৃজিত এই প্যারাবনের ওপরও স্থানীয় এক শ্রেণির মানুষের লোলুপদৃষ্টি পড়েছে। ইতিমধ্যে বদরখালীর দক্ষিণে তিন নম্বর ব্লকের প্রায় ২০০ একর প্যারাবন উজাড় করে সেখানে গড়ে তোলা হয় চিংড়িঘের। আবার রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী কিছু দুর্বৃত্ত একই কায়দায় ছিরাদিয়াসহ আশপাশের প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের তৈরি করে।এসব প্যারাবন নিধনের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তিনি মামলাও করেছেন।

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসহ লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় অল্পসংখ্যক গাছ মারা গেছে। তবে তাতে বনে অতটা প্রভাব পড়েনি। অবশ্য দেশিয় আরেকটি সংস্থা ‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা’ও(উবিনীগ) উপকূলীয় বদরখালী মৌজাসহ আশপাশের বেশ কিছু জেগে ওঠা চরে প্যারাবন সৃজন করে চলেছে। জেগে ওঠা চরে প্যারাবন সৃজনে ১৯৯২ সাল থেকে জাপানের পৃথক স্বেচ্ছাসেবী দল বাংলাদেশে আসা শুরু করে। তারা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও হাঁটু পরিমাণ কাদা মাড়িয়ে হৈ-হুলোড় করে উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে রোপণ করে গাছের চারা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশ রক্ষায় বেশি করে গাছ লাগানোর জন্য তারা সঙ্গীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে।

২০১৪ সালে প্যারাবন সৃজনে আসা ওআইএসসিএ দলনেতা মাসাইউকি ওনো বলেন, বাংলাদেশে এসেছি আমরা প্যারাবন সৃজন করতে। এখানে এসে যখন আমরা দেখি প্যারাবন উজাড়ের দৃশ্য তখন বড় কষ্ট লাগে। এ ক্ষেত্রে সবার উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় আরো বেশি সচেতন হওয়া এবং এখন থেকে একটি গাছও যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য ভূমিকা রাখা।’

দলের সদস্যসচিব সিনোবো ইউসিহারা বলেন, ‘বিপন্ন পরিবেশ রক্ষায় আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে গাছ রোপণ করে আসছি। আমাদের সংগঠনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। প্রতিবছর একবার সময় করে আমরা ছুটে যাই গাছ রোপণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।

পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম চকরিয়ার সভাপতি এম আর মাহমুদ বলেন, ‘ওআইএসসিএ চকরিয়া সুন্দরবন রক্ষায় যে উদ্যোগ নিয়েছে তার গুরুত্ব বলে বোঝানো যাবে না। তাদের সৃজন করা প্যারাবন দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। এখন হারিয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা এই প্যারাবন রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে মানুষরূপী দুর্বৃত্তদের থাবায় আবারও এই বন নিঃশেষ হয়ে যাবে। ’

এ বিষয়ে পশ্চিম বড় ভেওলা ইউপির চেয়ারম্যান আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ‘সুন্দরবন নিয়ে পুরো বিশ্বের সম্পদ, গর্বের সম্পদ। চকরিয়া সুন্দরবনও খুব একটা পিছিয়ে থাকত না। এই সুন্দরবনকে ঘিরে বসবাস ছিল জেলে ভাওয়ালি, মৌয়ালসহ নানা সম্প্রদায়ের মানুষের। ছিল নানা জীব-জন্তুর আবাস। কিন্তু চিংড়িঘেরের কারণে সব কিছুই ছারখার হতে শুরু করে আশির দশকে। জাপানি পরিবেশবাদী সংস্থাটি সেই সুন্দরবনকে আগের মহিমায় ফিরিয়ে আনতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে।

ওআইএসসিএ ইন্টারন্যাশনালের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর রহিম উল্লাহ বলেন, ‘১৯৯২ থেকে একাধারে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাপানি পরিবেশবাদী সংস্থাটির ব্যানারে বিলুপ্ত চকরিয়া সুন্দরবনে প্যারাবন সৃজন করা হয়। প্রতিবারই আমি জাপানি দলের সঙ্গে ছিলাম। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেওয়ার পর বিগত দুই বছর স্বেচ্ছাসেবী দলটি আর আসেনি। শতভাগ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত হলে তারা আবারও আসবে প্রত্যাশা করি। ’

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল মতিন বলেন, ‘বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবনে জাপানিদের রোপিত যেসব বৃক্ষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তা রক্ষা করতে হবে। উপকূলীয় বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে। ’

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় অনেকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। যতবারই গেছি, আমাকে মুগ্ধ করেছে প্যারাবন। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকার কারণে গত দুই বছর জাপানি দল না এলেও সংস্থার এখানকার দায়িত্বরতরা প্রতিবছরই প্যারাবন সৃজন করে চলেছেন। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এই বন নিধন চেষ্টার খবর পেলেই তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া আছে।’

চকরিয়া সুন্দরবনের পর্যটন সম্ভাবনা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে যে পরিমাণ প্যারাবন দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে অনেকেই ছুটে যান। কিন্তু এই বন নিয়ে তেমন প্রচার নেই। ভালোভাবে প্রচার পেলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পারলে এই প্যারাবন দ্রুতই ভ্রমণপিপাসু ও পর্যটকদের জন্য আলাদা বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন