গুইমারা ট্রাজেডির ৬ বছর, সন্ত্রাসীদের বিচার হয়নি আজও

guimara pic 16-04-2015 copy

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

আজ ভয়ানক সেই ১৭ এপ্রিল। ২০১১ সালের এ দিনে ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির বহিরাগত স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ি-বাঙ্গালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার প্রয়াসে শান্ত পাহাড়কে অশান্ত করে জন্ম দেয় এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের। এদিন উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে নিরপরাধ তিন বাঙ্গালী শ্রমিক। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায় হারিয়েছে প্রায় দু’শতাধিক ঘর-বাড়ি। উশৃঙ্খলদের দেয়া আগুনের লেলিহান শিখা পুড়ে ছাই করে দিয়েছে তাদের ঘর-বাড়িসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে।

২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার বড়পিলাক কচু বাউন্তী এলাকায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালীদের ধারলো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় নোয়াব আলী, আয়ুব আলী ও সুনিল চন্দ্র সরকার। আহত হয়েছিল অন্তত ৩০জন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের উত্তর শণখোলাপাড়া ও রেয়ং মরং পাড়ায় এবং মানিকছড়ির মহামুনি কার্বারী পাড়ায় উত্তেজিত জনতা পাল্টাপাল্টি নিরহ পাহাড়ি-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আগুনের লেলিহান শিখা শুধু এসব ঘর-বাড়িকেই পুড়ে ছাই করে দেয়নি, ধ্বংস করে দিয়েছে শত শত বছরের পাহাড়ি-বাঙ্গালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে।

06 copy

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালে একদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা বিক্ষোভ মিছিল করে রাস্তায় নেমে এসে চট্রগ্রাম-ফেনী-খাগড়াছড়ি সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাংচুর করে। বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়িরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ফলে মানিকছড়ি ও গুইমারা উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালির মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাৎক্ষণিক ভাবে রাস্তায় নেমে আসে। পাশাপাশি মানিকছড়ি, গুইমারা ও রামগড় তিন উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছেন, যে জমি নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত তা কাগজ-পত্রে বাঙ্গালিদের জায়গা। দীর্ঘ দিন উপজাতীয় একটি মহল বাঙ্গালীদের উচ্ছেদ করে এ জায়গা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত দখল করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এ হত্যা কাণ্ড ঘটিয়েছিল। তবে যে জায়গা নিয়ে রক্তপাত হানাহানি এত কিছু ঘটে গেল, সেই জায়গায় বাঙ্গালীরা আজও যেতে পারেনি। অদ্যাবধি এর কোন সমাধান না হওয়ায় শঙ্কিত এলাকাবাসী। যে কোন সময় এ ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।

08 copy

অনুসন্ধানে জানাযায়, হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করে। হত্যা মামলায় ৫জনকে চিহিৃত করে অজ্ঞাত দুই/আড়াইশ উপজাতীয় সন্ত্রাসীকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলা নং-১, তারিখ-১৮-৪-২০১১ইং। এছাড়াও অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনায় অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করে অপর একটি মামলা করে পুলিশ। মামালা নং-২, তাং-১৯-৪-২০১১ইং।

এ পরিস্থিতিতে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দিপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ি সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহেদুল আলমসহ সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত পূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে ছিলেন।

এরপর তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সালা উদ্দিনের নেতৃত্বে অন্য দুই সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন সাইদী ও রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোপাল চন্দ্র দাসকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তদন্ত কাজ শুরু করেন এবং এর রিপোর্টও জমা দেন। কিন্তু এত কিছুর পরও অদ্যাবধি এ হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার পায়নি নিহতের পরিবারগুলো।

04 copy

এদিকে দীর্ঘ প্রায় এক বছর মামলার বাদী এসআই মঞ্জুরুল আবছার তদন্ত করার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদী হওয়ায় এসআই মুঞ্জুরুল আবছারের পরিবর্তে এসআই ঠাকুর দাস মণ্ডলকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব প্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা ঠাকুর দাস মণ্ডল মাত্র ১৫ দিনের তদন্তে দায়সারাভাবে ১১-০৮-১২ তারিখে মামলার চূড়ান্ত চার্জসিট প্রদান করে। তার তদন্তে হত্যা মামলায় ৩১জন উপজাতি এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মামলায় ২৮জন বাঙ্গালীকে চিহিৃত করে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আসামি করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ।

অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মামলায় ২৮জন বাঙ্গালী আসামি ২০১৩ সালে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পায়। দীর্ঘ কয়েক বছর মামলা চলার পর মামলা থেকে বেকোসর খালাস পান ২৮বাঙ্গালী আসামি। এদিকে তিন বাঙ্গালী শ্রমিক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৩১জন উপজাতীয় আসামির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও অদৃশ্য কারণে আসামিরা দীর্ঘ কয়েক বছর আদালতে হাজির হয়নি। সম্প্রতি সময়ে আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন নামুঞ্জুর করে আসামিদের জেল হাজতে পাঠান। পরবর্তীতে বিভিন্ন তারিখে জামিনে রেব হয়ে আসে আসামিরা। বর্তমানে হত্যা মামলাটি বিচারাধীন।

অন্যদিকে ৩ বাঙ্গালীকে হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবি করেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সাংসদ ও সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূইয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা শাখার সভাপতি আবু ইউছুফ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মিল্লাত, পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এ্যাডভোকেট এয়াকুব আলী চৌধুরী।

07 copy

রবিবার দুপুরে পৃথক পৃথক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানান।

বিবৃতিতে ওয়াদুদ ভূইয়া ১৭ এপ্রিল বড়পিলাক হত্যা ট্রাজেডির ৬ষ্ঠ বার্ষিকীতে ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন, এ ঘটনায় নিহতদের তিনটি পরিবার আজ অনাহারে-অর্ধাহারে অমানবিকভাবে জীবন যাপন করছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক কর্তারা তাৎক্ষণিক ভাবে নানান আশ্বাস দিলেও এখনো এসব বাস্তবায়ন না করায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের অভিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক বিচারের দাবি করেন তিনি। এছাড়াও ভবিষ্যতে যেন এঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা শাখার সভাপতি আবু ইউছুফ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মিল্লাত ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার পূর্বক শাস্তি দাবি করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এছাড়াও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এ্যাডভোকেট এয়াকুব আলী চৌধুরী জানান, নিহতদের পরিবারগুলো এখনো অনাহারে-অর্ধহারে দিনাতিপাত করছে। তাই দ্রুত নিহত পরিবারেরর প্রতি ক্ষতি পূরণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এছাড়াও এখনো সন্ত্রাসীদের হামলায় হতাহতের কোন সুষ্ঠ বিচার না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অধিকার বঞ্চিত পার্বত্য বাঙ্গালীদের প্রাণ প্রিয় সংগঠন পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ’র ৮ দফা দাবি যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।

অন্যদিকে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সিনিয়ার সহ-সভাপতি আব্দুল মাজিদ জানান, ন্যাক্কার জনক এ ঘটনার প্রতিবাদ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবিতে আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। সংগঠনটির খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি লোকমান হোসেন জানান, ঘটনাস্থল বড়পিলাক এলাকায় কালো ব্যাচ ধারন ও কালো পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন ৫দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। কর্মসূচির মধ্যেছিল তিন পার্বত্য জেলায় কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, ঘটনাস্থল বড়পিলাক ও খাগড়াছড়ি জেলা শহরের শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় কালো পতাকা উত্তোলন, প্রতিবাদ সমাবেশ, সকল মসজিদে দোয়া, গীর্জা ও মন্দিরে প্রার্থনা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক পথ ও নৌপথ অবরোধ, সর্বশেষ ২৫এপ্রিল তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা। এতসবের পরও প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় না আনায় হতাশায় ভুগছে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালীরা। তাদের প্রশ্ন আদৌ কি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পাবে নিহতদের স্বজনরা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন