গণহত্যার স্থান কফি আনান’র পরিদর্শনের পরই মংডু‘র নদীতে ফের লাশ

টেকনাফ প্রতিনিধি:

মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যে (পূর্বের আরাকান) স্থানীয় মুসলমানদীর মংডুর গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। সেখানে গিয়ে তিনি বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ধ্বংসস্তুপ পরিদর্শন করেছেন, কথা বলেছেন নির্যাতনের শিকার মানুষজনের সঙ্গে।

শনিবার সকাল ১১ টার দিকে কফি আনানের নেতৃত্বাধীন ৬ জন দেশীয় ও ৩ জন বিদেশী সদস্যের প্রতিনিধিদল হেলিকপ্টার যোগে মিয়ানারের মংডু টাউনশীপের ফুটবল খেলার মাঠে অবতরণ করেন। পরে সেখান থেকে গাড়িযোগে মংডু কেয়ারিপাড়া, নাছিংপাড়া ঘুরে দেখেন।  দেশটির সরকারের মতে, প্রদেশটিতে সরকারি বাহিনীর অভিযানে ৮৬ জন মুসলিম নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ১০ হাজার মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। প্রকৃত পক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি। পরিদর্শনকালে সাবেক এই জাতিসংঘ প্রধান ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তিনি মতামতে জানান, সহিংসতা প্রদেশটিকে নতুন করে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং নতুন করে অনেককে ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। যা কখনোই কাম্য নয়। সরকারি বাহিনীকে সহিংসতা পরিত্যাগ করতেও মত দেন তিনি।

উল্লেখ্য, সিটওয়ে বিমানবন্দরের সামনে বিক্ষোভ করেন কয়েক শত মানুষ। তাদের দাবি, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিরসনে কোনো বিদেশির হস্তক্ষেপ চান না তারা। কফি আনান কমিশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সেটি সরাসরি দেশটির প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে দেবেন। গেলো সেপ্টেম্বরেও এই কমিশন রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করেছিল।

এদিকে মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনপদে কফি আনান পরিদর্শন শেষে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ফের তান্ডব চালাচ্ছে। আর সীমান্তে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে নেমেছে সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। গত বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত তাদের গুলিতে প্রায় ৬০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। আটক হয়েছে ৯০ জন।

জানা গেছে, প্রতিনিয়ত নাফ নদীতে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুবাহী নৌকায় নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে তারা। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ও ভয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে কমপক্ষে ৬০ জন। নৌকা থেকে লাফ দেওয়ার পর কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক রোহিঙ্গা যুবক প্রতিবেদকের কাছে এমন মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সীমান্তের ওপার থেকেও এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।

নাফ নদীর ওপারের বাসিন্দা ও এপারে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডুতে সে দেশের সেনাবাহিনীর তাণ্ডব থেকে বাঁচতে হাজারো রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ নাফ নদীর ওপারে অবস্থান করছে। নদীর উভয় তীরে থাকা দুই দেশের দালালরা অর্থের বিনিময়ে তাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে।

বরইতলী এলাকার দালাল নুরুল আলম বিয়াই জানান, শুক্রবার রাতে নাফ নদীর মিয়ানমার অংশ থেকে একটি বড় নৌকা বোঝাই হয়ে লোকজন নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য রওনা হয়। নৌকাটি লক্ষ্য করে বিজিপি সদস্যরা উপর্যুপরি গুলি চালাতে থাকে। নদীর ধারে বাড়ি হওয়ায় তিনি স্পষ্টই গুলির শব্দ শুনতে পান। আর তিনি নদীর ওই অংশে সারি সারি লাশ ভাসতে দেখেন। তিনি ও স্থানীয় অন্য অনেকে গণনা করে ভাসমান অবস্থায় কমপক্ষে ৬০টি লাশ দেখতে পেয়েছেন।

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বিজিপি ৬৬ জনকে আটক করে মংডু শহরে নিয়ে গেছে বলে তিনি শুনতে পেয়েছেন। এছাড়া বরইতলী এলাকার মো: উল্লাহ,  সাদেক, সেলিম নামে ৩ দালালকে আটক করেছে মিয়ানমারের বিজিপি।

প্রতিবেদককে তিনি বলেন, বুধবার রাত ৮টায় নাফ নদীর মিয়ানমার প্রান্ত থেকে একটি নৌকাযোগে অনেক শিশু, নারী ও পুরুষ বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। দুই ছেলে সলিম উল্লাহ (১৮) ও সালামত উল্লাহ(১৪) নিয়ে তিনিও ওই নৌকায় ছিলেন। নৌকাটি সামনের দিকে আধা কিলোমিটার এগোনোর পর হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে নৌকাটির দিকে স্পিডবোট ছুটে আসতে থাকে। এ সময় নৌকার আরোহীদের অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। তিনি অন্ধকারের মধ্যেই দেখেন, গুলিবর্ষণকারীরা বিজিপির সদস্য। উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের মুখে তাদের বহনকারী নৌকাটি আংশিক ডুবে গিয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এ সময় অনেকেই নাফ নদীতে লাফিয়ে পড়ে। আবার শিশুসহ কেউ কেউ নৌকায়ই রয়ে যায়। তিনিও নদীতে লাফ দেন। ওদিকে বিজিপি সদস্যরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে নৌকাটি তাদের স্পীডবোটের সঙ্গে বেঁধে মিয়ানমারের দিকে নিয়ে যায়। নৌকাটি বিজিপি নিয়ে গেলেও যারা নদীতে লাফ দিয়েছিল তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা ইমাম হোসেন জানেন না। তবে তাকে উদ্ধার করেছে নাফ নদীতে মাছ ধরার একটি নৌকা। ওই নৌকার মাঝি রশিদ আহমদ তাকে টেকনাফের কেরুনতলী এলাকার একটি বাড়িতে পৌঁছে দেন। ওই বাড়িতেই বৃহস্পতিবার উদ্ধার হওয়া ইমাম হোসেনের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তার দুই ছেলে সলিম উল্লাহ ও সালামত উল্লাহর ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না।

বিজিপির গুলিতে ৬০ জনের মৃত্যু এবং ৬৬ জনকে আটকের বিষয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মৃতদের মধ্যে কতজন গুলিবিদ্ধ আর কতজন পানিতে ডুবে মারা গেছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায়নি।

নাফ নদীতে গুলির শব্দের বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে. নাফিউর রহমান বলেন, প্রতিরাতে লোকজনের কাছে নাফ নদীতে চিৎকার হচ্ছে শুনে একটি টিম পাঠানো হয়। কিন্তু কোস্টগার্ড টিম গিয়ে কোনো রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা পায়নি। রোহিঙ্গারা অন্য স্থানে সরে গেছে বা তাদের বিজিপি নিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি নিজে গুলির শব্দ শুনিনি, তবে স্থানীয়রা শুনেছে বলে জানিয়েছে’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন