খাদ্যের অভাব ছিল তবে সংকট ছিল না থানচিতে

image 01

মংবোওয়াংচিং মারমা, থানচি প্রতিনিধি ( তিন্দু থেকে ফিরে)
দুর্গমতা ও পাহাড়ী পথে পায়ে হাঁটে চলাচল করার এক মাত্র অবলম্বন। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমস্যা, মঞ্জুরী ও কর্মসংস্থা অভাব, আর কোন বিকল্প পথ না থাকার কারণ ও বিগত বছরে পাহাড়ী জুমের ফলন কম হওয়া, তীব্র খরায়, মৌসুমী ফল ও উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বাজারজাত করণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়া ফলে, গত মার্চ থেকে বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার কয়েকটি দূর্গম ইউনিয়নে শুরু হয়েছিল খাদ্য অভাব । অর্থ থাকলে ও খাদ্য সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে মানুষকে দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

এই অভাবকে সম্প্রতিকালে কিছু সংখ্যক জনপ্রতিনিধিদের বরাত দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশাল খাদ্য সংকট দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হলেও বাস্তব চিত্র ছিল অন্যরকম।  এসব গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ভিত্তিতে থানচি উপজেলার উপদ্রুত তিন্দু ইউনিয়নের ৭,৮ও ৯নং ওয়ার্ডে এই প্রতিনিধি গত ২৮, ২৯ ও৩০ মে ৩দিনব্যাপী সরেজমিনে পরিদর্শন করলে ভিন্ন উপরোক্ত চিত্র পাওয়া যায়।

সরেজমিন রিপোর্ট

সেখানে খাদ্যাভাব আছে ঠিকই, কিন্তু খাদ্য সঙ্কট বলে যা বলা হচ্ছে তা অতি রঞ্জিত। তা ছাড়া খাদ্যাভাবে পতিত পরিবারের সংখ্যাও গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ৬০০ মতো পরিবারে খাদ্য সঙ্কট রয়েছে। কিন্তু আড়াই-তিন হাজার পরিবারের যে কথা বলা হচ্ছে তাও অতিরঞ্জিত।

জংলী আলু খেয়ে জীবনধারনের বিষয়ে যে খবর মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে তাও দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করেছে। পাহাড়ে উৎপাদিত এ আলু পাহাড়বাসীর স্বাভাবিক খাবারের মধ্যে অন্তর্গত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বাঁশকরুল(বাঁশের চারা) পাহাড়ী মানুষের উপাদেয় খাবার। কিন্তু খাদ্যাভাবে বাঁশ খেয়ে পাহাড়ী মানুষ জীবনধারণ করছে এমন সংবাদ পরিবেশন করা হলে সমতলের সাধারণ মানুষের কাছে তা ভিন্ন অর্থ প্রেরণ করবে।

গত ২৮ মে শনিবার দুপুর ১১ ঘটিকায় তিন্দু ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডে রুনাজন ত্রিপুরা পাড়া সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। এ পাড়ার ২৯ টি পরিবারের জনসংখ্যা ১০০ থেকে দেড় শত জন। তৎমধ্যে শিক্ষার্থী আছে ৬৫জন। ওই পাড়ার ইউএনডিপি শিক্ষিকা রনজিতা ত্রিপুরা(২৬) সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মঞ্জুরী ও কর্মসংস্থানের অভাব, অর্থনৈতিক অভাব, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন,পাহাড়ী পথ, জুমের ফলস হ্রাস পাওয়ার অত্র পাড়ার ১৭ পরিবার গত ইউপি নির্বাচন থেকে খাদ্যাভাবে দিন কাটাচ্ছে।

IMAGE 02

অন্য পরিবারগুলো থেকে সহযোগিতা নিয়ে এক বেলা ভাত আর একবেলা জংলী আলু জীবন ধারণ করছে। চলতি বছরে জুমের ধান না ওঠা পর্যন্ত আগামি ৪ মাসের কথা বিবেচনা করেই তারা এক বেলা ভাত আর এক বেলা আলু খেয়ে বেঁচে রয়েছে। শিক্ষক রশিদ চন্দ্র ত্রিপুরা, লরেন্স ত্রিপুরা, শিক্ষিকা অনিতা ত্রিপুরাসহ পাড়ার অবস্থানরত প্রায়ই একই কথা বললেন। শিক্ষকেরা আরো বলেন, দীর্ঘ ১ বছর যাবৎ ইউএনডিপির বেতন না পাওয়ার তারা ও অর্থ সংকট আর খাদ্যাভাব সৃষ্টির আশঙ্কা করেছেন ।

তারা সরকারিভাবে জুম চাষের ফসল ওঠা পর্যন্ত প্রায় ৪ মাস ব্যাপী সহযোগিতার আবেদন করেন। এতে তারা অভাব থেকে কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে দৃঢ় বিশ্বাস । পরে ২ ঘন্টা পাহাড়ী পথ হেঁটে তিন্দু ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডে হরিশ চন্দ্র পাড়ায় ১৩টি পরিবার পরিদর্শনে গেলে সেখানেও একই দশা বলে হরিশ চন্দ্র ত্রিপুরা(৬০) জানান ।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ৬নং ওয়ার্ডে বিজিবি ক্যাম্পের ১০০ গজ দূরত্বে থুইসা খিয়াং পাড়া অর্থাৎ জিন্নাপাড়ায় ২৯টি পরিবারের মধ্যে ২১ পরিবার একই চিত্র দেখা মিলল। পর দিন বিকাল ৩টায় ৮নং ওয়ার্ডে জ্যোতি ত্রিপুরা পাড়া ৭ পরিবার, সাজেন খিয়াং পাড়া ৭ পরিবার, মংখয় খিয়াং পাড়া ৪ পরিবারও একই কথা জানায়। সন্ধ্যা ৭ টায় ৯নং ওয়ার্ডে লালদো ত্রিপুরা পাড়া ৪ পরিবার, বর্জুন ত্রিপুরা পাড়া ৬ পরিবার, ইচ্ছামনি ত্রিপুরা পাড়া ৩২ পরিবারের মধ্যে ৩১ পরিবার ও বাধুন্যা ত্রিপুরা পাড়া ৯ পরিবারে গিয়ে একই চিত্র শোনা যায় ।

গত সোমবার সকাল ৯ টায় রেমাক্রী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে নিয়াউ ম্রো কারবারী জানান, তার ওখানে ১৩ পরিবারে খাদ্য অভাব, তবে আজ বিজিবির রেশন আনার জন্য ৯জন শ্রমিক কাজ করতে গেছে। তারা দৈনিক ৩শত টাকা করে দিলে চাউল ক্রয় করে আসলে সবাই মিলে ভাগ করবো।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৬ হাজার পরিবারের কৃষি ও জুম জমি রয়েছে ২৭৫০ হেক্টর , ২৮শত পরিবার কৃষি কাজে লিপ্ত নয়, ৩৮৫০ পরিবার কৃষি কাজের সাথে নিয়োজিত, তন্মধ্যে চাহিদা ৪ হাজার ৫শত মে:টন, উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৭শত ৩৫ মে.টন, ঘাটতি থাকে ৫শত মে.টন।

গত ২০১৫ সালে মোট উদ্পাদন হয়েছে ৩২২৪ মে:টন, যা ২০১৫ সাল থেকে কম । তবে বাজারের ব্যবসায়ীরা আমদানী করে ৩ থেকে ৪ শত মে.টন বান্দরবান থেকে এনে তা বিক্রি করে উপজেলা বিভিন্ন বাজার এবং জন সাধারনে নিকট। জুমের ফসল আউজ ধান ২৭৫০ হেক্টরে ৩৫শত মে:টন, আমন ধান ৪০ হেক্টরে ১১০ মে:টন, বোরো ধান ৩২ হেক্টরে ১৩২ মে:টন উদ্পাদন হয়েছে।

তবে সমতলের জমিতে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদন ৩ থেকে সাড়ে ৩ টন হলেও জুম চাষে ধান উৎপাদন হয় এক টনের কিছুটা বেশি। এর মধ্যে গত বছর অতিবৃষ্টির ফলে জুমের ফলন কমেছে। সম্প্রতি তীব্র তাপদাহে জুমের অন্যান্য সাথী ফসলও কমে আসছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় পাহাড়ে অতিমাত্রায় জুম চাষের ফলে মাটির গুণাগুণ কমে ফলনও কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা চালু করা না গেলে জুম চাষের মাধ্যমে পাহাড়ী নৃ-গোষ্ঠীর জীবনধারণ আগামীতে কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির।

তিন্দু ইউনিয়নের সরেজমিনের পরিদর্শনের সময় থানছি উপজেলা চেয়ারম্যান ক্যহ্লাচিং মারমা বলেন, উপজেলায় প্রায় ২শত পাড়ার মধ্যে মাত্র ১৬টি সরকারি প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে দুর্গম এলাকা শিক্ষা আলো থেকে পিছিয়ে, শিক্ষা আলো যদি না থাকে, তাহলে সামাজিক আচার আচারণসহ নিজের কর্মসংস্থা বা মঞ্জুরী খোঁজার শক্তি থাকেনা।

তিনি বলেন, এখানে আদি প্রথাগত জুম চাষ হলো এক মাত্র অবলম্বন । জুমের ফসল না হলে সাধারণ ভাবে আর্থিক সংকট হয় । আর্থিক সংকট হলে খাদ্য অভাব চলে আসবে সামনে । আর যোগাযোগ এক মাত্র পায়ের হাঁটা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। এ অবস্থায় পাহাড়ী এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জুম চাষ থেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পার্বত্য এলাকার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষা আলো ছড়ানোসহ খাদ্য অভাবগ্রস্ত এলাকায় আগামি ৪ মাস অর্থাৎ অক্টোবর পর্যন্ত খাদ্য সহযোগিতা ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করছেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “খাদ্যের অভাব ছিল তবে সংকট ছিল না থানচিতে”

  1. প্রভাবিত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো। প্রতিবেদকের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আপনি কী জানেন, জুম চাষের উপযুক্ত ভূমির পরিমান কমে যাচ্ছে, হাজার হাজার একর জমি পর্যটনের নামে ইজারা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে, পাথর উত্তোলন করে প্রাকৃতিক পানির উৎস ঝিড়ি, ঝর্ণা এখন মৃত যা পাহাড়ের জনগনের তৃঞ্ষা নিবরণের একমাত্র উপায় ছিল । মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন ধারণের অযোগ্য হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তৈরি করা পায়তারা করা হচ্ছে। পর্যটন করে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই বিপুল জায়গা জমির মালিক ও কৌটিপতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে আর সাধারণ দরিদ্র জনগন হয়ে যাচ্ছে বাস্তু হারা, জুম হারা, এলাকা ছাড়া,কেউ কেউ দেশান্তরিতও হয়েছে। এ সব ঘটনা দেখেও অদৃশ্য কোন কারণে নির্বাক তথাকথিত আমাদের স্থানীয় রাজনীতিবীদেরা। আঞ্চলিক দল আছে একে অপরকে দোষারোপ করে বিরোধী দলকে নিমূর্ল করার চিন্তায় যা থেকে সাধারণ জনগনও নিরপরাধ সাধারণ জনগনও রেহায় পাচ্ছেনা, তাদের চাঁদাবাজীতে আমরা সাধারণ জনগনও অতিস্থ।
    পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদেও নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা দরকার রয়েছে। প্রয়োজনে সংবিধানে তা অন্তর্ভূক্ত করে পাশ করা হওক। তথাকথিত দলীয় ও অযোগ্য ব্যক্তিদের এসব পরিষদে সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়েছ। আমরা বলার চেষ্টা করি দুর্নীতি মুক্ত বালাদেশ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোন বিভাগের, যে কোন পদের চাকুরী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও পরিষদের সদস্যদের দোড় ঝাপ শুরু হয়ে যায় ঘুষের আশায় কে কোন প্রার্থী হতে কত টাকা হাতিয়ে নিতে পারে, প্রশাসন জেনেও কিছুু করার প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ বোঝার সামর্থ সীমিত বলেই কথা। আর এর পর রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কৌটা, চাকমা কোটা,অমুক সমুক কৌটা আমরা শিক্ষিত লোকদের কপালে হাত। পুরো দেশ যোগ্য ব্যক্তিদের চিনতে মূল্যায়ন করতে নারাজ।
    আমার এই মন্তব্য মনে হবে অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু এ ধরণের অনেক মন্তব্য পাহাড়ের জনগনের মনে দুমড়ে মুচরে সলিল হয়ে যাচ্ছে। যা কেউ শুনতে পায় না। তারা মনে করে কার কাছে বলবে,বলে লাভ কী হবে কে শুনবে, কী করবে। কারণ সর্বত্রই অনুভূতিহীন যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত।

    মাননীয় উপজেলা চেয়াম্যান মহোদয়কে ধন্যবাদ দিতে চায় সত্যি কথা বলার জন্য যে, পাহাড়ে গ্রামগুলোতে এখনও শিক্ষাকেন্দ্র নেই। এই হলো আমদের উন্নয়নশীল দেশের নমুনা।
    পাহাড়ে অনেক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, ক্লিনিক, সরকারী বিভিন্ন বিভাগের অফিস স্থাপনার চিহ্ন থাকলেও যারা পরিচালনা করবে দেখবে তারা অনুপস্থিত। কিন্তু বেতন নিচ্ছে গুনে গুনে। সরকারী ন্যস্ত বিভাগ জানলেও কেউ কিছু বলছেনা। পাহাড়ের কান্না যাদের শোনার কথা তারা আজ অন্ধ, তারা মানসিক প্রতিবন্ধী, তারা বাক প্রতিবন্ধী। হয়তো এভাবেই চলবে পাহাড়ের জীবন।
    পরিশেষে বলতে চায়, বিগত বছরে দুর্গম পাহাড়ে খাদ্য অভাব যে ছিল তা অসত্য নয়, দিনের আলোর মতোই সত্য ছিল। যদি অসত্যই হয় কেন হেলিকপ্টারে করে জেলা সদর হতে খাদ্য প্রেরণ করা হয়েছিল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন