খাগড়াছড়িতে ডবল মার্ডার নায়ক কালিবন্ধু’র বহুরূপ
নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি:
খাগড়াছড়িতে পিতা ও পুত্রকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা ও দুই নারী আহত হওয়ার ঘটনার নায়ক স্থানীয় ইউপি সদস্য কালিবন্ধু ত্রিপুরার নানা রূপ রয়েছে। তিনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেও তিনি কখনো জেএসএস(এমএন) আবার কখনো আওয়ামীলীগ। তবে তার ছেলে যতীন ত্রিপুরা ইউপিডিএফ’র রাজনীতির সাথে জড়িত।
স্থানীয়ভাবে পুরো পরিবারটি চিহিৃত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত। তার দাপটে এলাকার সাধারণ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষ সব সময় আতংকের মধ্যে দিন পার করেন। নির্বাচন এলে তিনি প্রার্থী হন। তবে জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়ে না তার। এলাকার মানুষকে জিম্মি করে তিনি নির্বাচিত হয়ে যান। যারা তাকে ভোট দেয়নি এমন মানুষগুলোকে তিনি ভোটের পরপরই নানাভাবে নির্যাতন করেন। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে তাকে ভোট দিয়ে থাকেন।
তিনি মূলত অস্ত্র ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজ। তিনি ইতি পূর্বে অস্ত্র ও ভারতীয় রূপীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে পুত্র যতন ত্রিপুরাসহ আটক হয়েছিলেন। আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে আবার একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। সে মূলত: এলাকায় আতংক। তার রয়েছে একটি বিশেষ বাহিনী। যারা গত বৃহস্পতিবার রাতে দেবতা পুকুর এলাকায় নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে। এ তান্ডবে প্রাণ গেছে দু’জন। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন দুই নারী।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে জেলা সদরের থলিপাড়া এলাকায় কালিবন্ধু ত্রিপুরা ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় ব্যবসায়ী চিরঞ্জয় ত্রিপুরা ও তার ছেলে কর্ণ জ্যোতি ত্রিপুরা নিহত এবং চিরঞ্জয় ত্রিপুরার স্ত্রী ভবেলক্ষী ত্রিপুরা ও ছেলে কর্ণ জ্যোতি ত্রিপুরার স্ত্রী বিজলি ত্রিপুরা গুরতর আহত হন। সন্ত্রাসীরা ব্যবসায়ী চিরঞ্জয় ত্রিপুরা ও তার ছেলে কর্ণ জ্যোতি ত্রিপুরা প্রথমে গুলি ও পরে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।
চিরঞ্জয় ত্রিপুরার মেজো ছেলে নীহার ত্রিপুরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা পরিবারের সকল সদস্য এক সাথে বসে ভাত খাচ্ছিলেন। এ সময় খাগড়াছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য কালিবন্ধু ত্রিপুরার নেতৃত্বে ৩০/৪০ জন সন্ত্রাসী চিরঞ্জয় ত্রিপুরার বাসায় গুলি ও বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় সে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান তার পিতা চিরঞ্জয় ত্রিপুরা। আহত অবস্থায় পরিবারের অপর তিন সদস্যকে হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কর্ণ জ্যোতি ত্রিপুরাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রতিবেশী কেউচিং মারমা জানান, গত ৭ মে কালিবন্ধু ত্রিপুরা নেতৃত্বে চিরঞ্জয় ত্রিপুরা আরো এক দফা হামলা হয়। তিনি ১০ মে পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ ঘটনায় থানায় মামলার দায়ের করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। অবশেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতে কালিবন্ধু ত্রিপুরাসহ ১৪ জনকে আসামী করে মামলা করে চিরঞ্জয় ত্রিপুরা। মামলা করার মাত্র ৮ ঘন্টার ব্যবধানে কালিবন্ধু ত্রিপুরা ও তার সহযোগিদের হামলায় প্রাণ গেল চিরঞ্জয় ত্রিপুরা ও তার ছেলে কর্ণ জ্যোতি ত্রিপুরা। শুধু তাই নয়, হামলার সময় সন্ত্রাসীরা নারীদের উপরও পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।
এদিকে শুক্রবার দুপুরে চিরঞ্জয় ত্রিপুরা ও ছেলে কর্ণ জ্যোতি ত্রিপুরার লাশ ময়না তদন্তের পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিকালে থলিবাড়ীতে তাদের লাশ দাহ করা হয়। এ সময় স্বজনদের কান্নায় হাসপাতাল এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ক্ষেত্র মোহন ত্রিপুরা জানান, ইতিপূর্বেও দুই পরিবারের মধ্যে কয়েক দফা হামলা ও মামলার ঘটনা ঘটে। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে বসে মীমাংসা করা হয়।
অপর একটি সূত্র জানায়, বছর খানিক আগে কালি বন্ধু ত্রিপুরা ও তার ছেলেকে নিরাপত্তা বাহিনী অস্ত্র আটক করে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জেল থেকে ছাড়া পায়। অতিসম্প্রতি কালি বন্ধু ত্রিপুরা অপর ছেলে যতীন ত্রিপুরা পাচ রাউন্ড গুলি ভর্তি একটি বিদেশী পিস্তলসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়। সে এখনো জেলে রয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারী ভোর রাতে নিরাপত্তা বাহিনী খাগড়াছড়ির জেলা সদরের বিজিতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, গুলি, ভারতীয় রুপী ও বিভিন্ন সরঞ্জামসহ খাগড়াছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কালি বন্ধু ত্রিপুরা(৪৫) এবং তার ছেলে যতীন ত্রিপুরাকে (২২) আটক করে।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ২টি দেশীয় তৈরি বন্দুক, ৩ রাউন্ড গুলি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক, বেশ কিছু ভারতীয় মুদ্রা, ও ১টি বাইনোকুলার উদ্ধার করে। বেশ কিছু দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পায় তারা।
চলতি বছরের ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ির মাইচছড়িতে চাঁদা আদায়কালে সাত রাউন্ড গুলি ভর্তি একটি বিদেশী পিস্তলসহ কালিবন্ধু ত্রিপুরার যতীন ত্রিপুরা ফের আটক করে নিরাপত্তা বাহিনী। যতীন ত্রিপুরা এখনো কারাগারে আছেন।
সম্প্রতি কালিবন্ধু ত্রিপুরা ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে থলিবাড়ী ও দেবতা পুকুরসহ বেশ কয়েকটি দূর্গম এলাকায় বসবাসরত জুম নির্ভর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠিকে জুমচাষে বাধাদান এবং সশস্ত্র আক্রমণসহ হুমকি প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ তার নেতৃত্বে প্রাণ গেলো দুটি তাজা প্রাণ। সে সাথে মাটির সাথে মিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, চিরঞ্জয় ত্রিপুরার ভিটেমাটি।
এদিকে শুক্রবার রাতে খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক আব্দুল হান্নান জানান, রাতে নিহত চিরঞ্জয় ত্রিপুরার পক্ষ থেকে থানায় একটি এজাহার পাঠানো হয়েছে। পুলিশ অভিযুক্তদের আটকের চেষ্টা চালাচ্ছে।