কেউ স্মরণ করেনি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ ক্যাপ্টেন আবতাবুল কাদের’কে

aftabul kadir pic copy

গুইমারা প্রতিনিধি:

কেউ স্মরণ করেনি মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ বীরউত্তম খেতাবে ভুষিত স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ ক্যাপ্টেন আবতাবুল কাদেরকে। নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে ৪৬তম শাহাদাত বার্ষিকী।

২৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার এ বীর শহীদের ৪৬তম শাহাদাত বার্ষিকীতে শুধুমাত্র রামগড়স্থ শহীদ ক্যাপ্টেন কাদের বিদ্যা নিকেতনে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করে দায়সারা ভাবে পালন করা হয় দিবসটি। পরে রামগড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে অবস্থিত শহীদের কবরে পুষ্পস্থাবক অর্পণ ও জেয়ারত করা হয়। কিন্তু দেশের প্রথম এ শহীদকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ভাবে কিংবা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পক্ষ থেকে তার শাহাদাত বার্ষিকী পালন তেমন একটা লক্ষ করা যায়নি।

১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাক ও মিজো বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেশের জন্য প্রথম শহীদ হন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম)। এ শহীদ বীর মুক্তিযুদ্ধাকে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা সদরে সমাহিত করা হয়। তাকে কবরস্থ করার সময় তার হাতে বিবাহের মেহিদীর রং ঝলঝল করছিল। তিনি সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে বাংলা মা’কে শক্রদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধে অন্যন্য অসাধারণ ও গৌরবউজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে তাকে মরনোত্ত্বর বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করেন।

জানাযায়, ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈত্রিক নিবাস ছিল লক্ষীপুরের রামগঞ্জে টিওড়া গ্রামে। তার মাতা রওশনারা বেগম একজন গৃহিনী হলেও বাবা অবদুল কাদের ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।

তিনি ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে ইংরেজিতে (সম্মান) ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি আর্টিলারী কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্ট ৪০ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদেন।

১৯৭১ সালে ২৮শে ফেব্রুয়ারি সংসার নামে একটি ছোট ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে সরকারী কর্মস্থল পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ থেকে ছুটিতে নিজবাড়ি ঢাকায় এসেছিলেন। মা প্রাণের টুকরো সন্তানের জন্য ঘরণী করে আনেন এক সুন্দরী বউ। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাক বাহিনী পৈচাসিক বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে পাক হানাদারদের নির্মম কর্মকাণ্ডের তীব্র ক্ষোভ, প্রতিরোধ আর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রিয় ঘর, ঘরণীর মধুর বন্ধন ছিন্ন করে তরুণ অফিসার ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।

যোগদান করেন ৮মে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়ার এক নম্বর সেক্টরে। ২৮ মার্চ তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে চট্রগ্রামের পথ বেয়ে ফেনীর শুভপুর হয়ে ২এপ্রিল রাতে কাদের পর্দাপন করেন সীমান্ত শহর রামগড়ে। শুরু হয় তার কর্মব্যস্ততা। রামগড় কে শত্রুমুক্ত রাখার লক্ষ্যে তিনি ইপিআর হাবিলদার কাশেম’র প্লাটুনসহ ৫ এপ্রিল সফল অপারেশন চালিয়ে ধুমঘাট রেলওয়ের ব্রিজ উড়িয়ে দেন।

প্রায় ৫০০ সংগ্রামী তরুণ এসে জড়ো হয় রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই অস্ত্র ট্রেনিং নেওয়া। এতদিন বেঙ্গল রেজিঃ আর ইপিআর (ইস্টপাকিস্তান রাইফেল্স) যুদ্ধ করেছে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে এবার করবে বাংলার তরুণ সমাজ। তিনি নিজেই প্রশিক্ষণার্থীদের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তার সহযোগী হিসেবে বেছে নেন ইপিআর সুবেদার একেএম, মফিজুল বারি (বিডিআর এর প্রথম উইং কমান্ডার) এবং কয়েকজন ইনস্ট্রাকটর প্লাটুনে ভাগ করে দেয়া হয় সবাইকে। শুরু হয় পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। শতশত মুক্তিকামী যুবক দুঃসাহসী যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

১০ এপ্রিল মেজর জিয়া, লে. খালেকুজ্জামানসহ ক্যাপ্টেন কাদের ৫০জনের একটি গ্রুপের সাথে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রামগড় ত্যাগ করেন। তিনি তার গ্রুপসহ মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি, মানিকছড়ি, বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেন। রাঙ্গামাটি বন্ধুক ভাঙ্গা নামক স্থানে অবস্থান কালে তারা প্রায় দুই লঞ্চবোঝাই পাকবাহিনীর হাতে বাধা গ্রস্থ হয়। প্রায় দুই ঘন্টা যুদ্ধে এ দ্বীপে শক্রপক্ষের বেশ কয়েক জন সৈন্য নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকবাহিনীর সদস্যরা।

এদিকে পাকসেনারা নিজেদের দলভারী করার জন্য হাজার হাজার মিজোদের তাদের দলে অর্ন্তভুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেয়। আর মুক্তি যোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘাঁটির উপর বিমান হামলা শুরু করে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর রসদ এবং গোলা বারুদ শেষ হবার পথে, তাছাড়া মুক্তি যোদ্ধাদের অধিকাংশেরই ছিলোনা পাহাড়ি এলাকায় কোন যুদ্ধের পূর্ব প্রশিক্ষণ। মুক্তি যোদ্ধারা পরবর্তীতে পজিশন দুর্বল হয়ে পড়ে প্রায়। ঠিক এ নাজুক পরিস্থিতিক্ষণে ২৭ শে এপ্রিল সকালে মহালছড়িতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা আক্রান্ত হয় শত্রু বাহিনীর হাতে। শত্রুরা ছিলো দলে ভারী ও একটি নিয়োমিত কমান্ডো কোম্পানী। তাদের ছিলো ১৫-১৬শ মিজোর দুটি ব্রিগ্রেড। যা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার চেয়ে দু’তিন গুন বেশি। ক্যাপ্টেন কাদের ছিলেন, রাঙ্গামাটি রেকিতে। রেকি শেষে মেজর শওকতের প্লান অনুযায়ী ক্যাপ্টেন কাদের অসীম সাহসের সাথে বীর দর্পে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন মহালছড়িতে তুমুল যুদ্ধে।

তার অসামান্য রনকৌশলের কাছে শত্রুরা হেরে গিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচানোর তাগিতে পাক হানাদাররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা মিজোদের সামনে রেখে একটার পর একটা আক্রমন চালিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। মুক্তি যোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমনে মিজোরা পিছু হঁটতে চাইলে পাকবাহিনীরা এমন ভাব দেখাত যে, পিছু হঁটতে চাইলে তারা নিজেরাই মিজোদের হত্যা করবে। তাই তারা এক রকম উম্মাদ হয়ে ওঠে।

এদিকে তিনটি এলএমজির মধ্যে একটি এলএমজি অচল হয়ে পরলে তা স্বচল করার চেষ্টা কালে শত্রুরা মুক্তিযুদ্ধাদের ঘিরে ফেলে, গর্জে ওঠে পাক-বাহিনীর মেশিন গান, তারা আফতারকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করলে মহালছড়ি থানার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে কবর স্থানের ডান পার্শে বটবৃক্ষের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ক্যাপ্টেন কাদের। যুদ্ধ দু’পক্ষের মধ্যে তখনও চলছেই। গুরুতর আহত অবস্থায় মেজর মীর সওকতের নির্দেশে সহকর্মীরা সহযোদ্ধা, শওকত আলী এবং সিপাহী ড্রাইভার আব্বাস আহত কাদেরকে বহন করে নিরাপদে একটি জীপযোগে রামগড় নিয়ে যাওয়ার পথে জালিয়াপাড়া নামক স্থানে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

এসময় গুইমারাতে আহত কাদেরকে পান করানো হয় জীবনের শেষ পানি। ২৭ শে এপ্রিল বিকালে শহীদ বীরযোদ্ধা ক্যাপ্টেন কাদের’র পবিত্র মরদেহ রামগড় নিয়ে আসা হয়। এসময় সকলের চোখে মুখে নামে শোকের ছায়া। সন্ধ্যার প্রক্কালে রামগড় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তফার পরিচালনায় শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের জানাজা নামাজ শেষে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতির স্বরুপ ১৯৭৩ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তার নামে স্মৃতি সৌধ (খাগড়াছড়ি), ভার্স্কয (মহালছড়ি), কেজি স্কুল (রামগড়), রাস্তার নাম করণ (রামগড়) করা হয়েছে। রামগড়ে চির নিদ্রায় শায়িত বীরযুদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের মরণোত্তর “বীর উত্তম” উপাধিতে ভূষিত করা হলেও তার নামে আজো কোন স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠান করা হয়নি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর দাবি শিঘ্রই রামগড়ে তার নামে একটি স্মৃতি যাদুঘর স্থাপনের জন্য জোর দাবি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন