কক্সবাজারে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় রোহিঙ্গারা
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
টেকনাফের হ্নীলা স্টেশনের সামান্য দক্ষিণে আলীখালী পাড়া। এই পাড়ার প্রবেশপথেই জাবের আহমদ সিকদারের বিশাল ভিটাবাড়ি। প্রভাবশালী এই ব্যক্তি তার ভিটায় কাঁচা ঘর তুলে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে ভাড়া দিয়েছেন। এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলো জানিয়েছে, প্রতি মাসে ৫০০ টাকা ভাড়ায় থাকছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, জাবের আহমদ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমারের ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে রয়েছে তার নেটওয়ার্ক। সেই সল্ফপর্ক ধরে ওপারের অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এখন তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
তবে জাবের আহমদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এলাকায় অনেকেই রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছেন। তিনিও মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করছেন।
জাবের আহমদের প্রতিবেশী তারই নিকটাত্মীয় জাফর আলম পেশায় মাদ্রাসা শিক্ষক। জাফরও তার জমিতে ঘর তুলে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পরিবারকে ভাড়া দিয়েছেন। এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা স্বীকার করেছেন, তারা মাসে ৫০০ টাকায় একেকটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন।
একই পাড়ার জাফর আহমদ ও জহির আহমদ। দু’জনেরই নাম রয়েছে ইয়াবা পাচারকারীর তালিকায়। এই দুই ব্যক্তিও তাদের ভাড়া ঘরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার থেকে তারা ভাড়া আদায় করছেন মাসে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় তাদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে। হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এইচ কে আনোয়ার জানিয়েছেন, অনেকেই আত্মীয়তার সল্ফপর্কে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। অনেকে বাসা ভাড়া দিয়ে আয় করছেন বিপুল টাকা। প্রশাসনও বিষয়টি অবগত রয়েছে।
টেকনাফের শামলাপুর বাজারের প্রধান সড়কের এক পাশে স্কুল মাঠ। সেখানে সেনাবাহিনী অস্থায়ী ক্যাল্ফপ করে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। সড়কের অন্য পাশে সারি সারি দোকানঘর। এই দোকানের পেছনে ভাড়া ঘরে থাকে শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবার। স্থানীয় প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিয়েছে এসব ঘর।
বাজারের একটু দক্ষিণে ব্রিজের কাছে রয়েছে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিনের জমি। এতদিন এই জমিতে ধান চাষ হলেও এখন জমি ভরাট করে সেখানে রোহিঙ্গা বস্তি বসানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয়। যদিও চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন অস্বীকার করেছেন ভাড়া আদায়ের বিষয়টি।
তিনি বলেন, একান্ত মানবিক কারণে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাফর আহমদের ভাড়া বাড়ি থেকে গত বুধবার অভিযান চালিয়ে ৩১ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিশেষ টাস্কফোর্স। একই দিন অভিযান চালানো হয় উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদির ছোট ভাই আবদুর শুক্কুর, টেকনাফের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হাজি সাইফুল করিম ও আনোয়ারের বাড়িতে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. এহসান মুরাদের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। তিনি জানান, বুধবার রাতে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ভাড়া দেওয়া বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। চেয়ারম্যানের ওই বাড়ির একটি রুম থেকে ১৫জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, টেকনাফের বিভিন্ন বাড়িতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার খবর পেয়ে কয়েকটি বাড়িতে এ অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫জন রোহিঙ্গাকে। যার মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। তাদের রোহিঙ্গা ক্যাল্ফেপ পাঠানো হয়েছে।
টেকনাফের স্থানীয় লোকজন জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অবস্থাপম্ন এবং যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা রোহিঙ্গা ক্যাল্ফেপ না গিয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরেও অবস্থান নিয়েছেন।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও মানবাধিকার নেতা অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের অধিকাংশ বাসাবাড়িতে অবস্থান করছে। পরিচয় গোপন করে তারা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে।
কক্সবাজার পৌর শহরের ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, লাইট হাউস পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন পৌর মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, এখানে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে। তাদের কারণে স্থানীয় লোকজন বেকার হয়ে পড়ছে। শহরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আটক করে ক্যাল্ফেপ পাঠানোর জন্য প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পৌর মেয়র।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, যে সব রোহিঙ্গা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে কোনো কোনো এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। প্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকায় চিরুনি অভিযান চালানো হবে।
সূত্র: সমকাল