এ মৃত্যুর শেষ কোথায়?

  • মাহের ইসলাম

সুন্দর এক সকালে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নৌকায় চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন এক ব্যক্তি। পথে, আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা নৌকাটি থামিয়ে লোকটিকে টেনে নেয়ার সময় সন্ত্রাসীদের পায়ে ধরে হতভাগ্যা স্ত্রী বারবার তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু তাদের মনে বিন্দুমাত্র দয়ার উদ্রেক হয়নি। বরং, এই হতভাগ্যাকে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিয়ে, ছেলে আর স্ত্রীর চোখের সামনেই গুলি করে।  নৃশংসতা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি – তাকে চিকিৎসার জন্যে কোথাও নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা প্রিয়জনদের। জীবন বাঁচানোর হাজারো আকুতি সত্বেও স্ত্রী-সন্তানেরা পাশে থেকে কিছুই করতে পারেনি; উল্টো,  করুণ এবং বীভৎস এক মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করা হয়েছে এক স্ত্রীকে, এক সন্তানকে। কারণ, মৃত্যু নিশ্চিত করার পরেই কেবল সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

শুনতে যতই নির্মম মনে হোক না কেন, এই ঘটনা কোন সিনেমার দৃশ্য নয়। কিংবা কোন মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির কল্পনাও নয়। গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ ২০১৯) রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার শিকার সুরেশ কান্তি তংচংগ্যা। যিনি ছিলেন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি; আগেরদিন নির্বাচন সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড শেষ করে রাঙামাটি ফিরছিলেন।

সম্প্রতি সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পার্বত্য অঞ্চলে শুধু এই একজনেরই প্রাণহানি ঘটেছে – তা নয়। বরং এর চেয়েও আরো বহুগুণ লোমহর্ষক ও নৃশংস ঘটনা ঘটেছে বাঘাইছড়িতে, ১৮ মার্চ সন্ধ্যায়। সারাদিনের ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচনী কর্মকর্তা- কর্মচারীরা যখন ফিরছিলেন, তখন তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে অতর্কিতে ব্রাশ ফায়ারে নিহত হয় ৭ জন, আর আহত হয় ২০ জনের বেশি। আহতদের মধ্য হতে ১৬ জনকে রাতেই হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সি এম এইচে আনা হয়। তন্মধ্যে ৬ জনকে পরে ঢাকা সি এম এইচে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ঘটনার ভয়াবহতা, যা কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে উঠে এসেছে, রীতিমত লোমহর্ষক এবং গাঁ শিউরে উঠার মতো। বিশেষ করে, ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থল এবং হাঁসপাতালের যে বিবরণ উঠে এসেছে, তা আতঙ্কজনক বা উদ্বেগজনক বললে, কমই বলা হবে। প্রাণে বেঁচে যাওয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ইয়াসমিন আক্তারকে উদ্ধৃত করে দৈনিক সমকাল (২০ মার্চ, ২০১৯) ঘটনার বর্ণনায় জানিয়েছে, “চারপাশ তখন পুরো অন্ধকার। উঁচু পাহাড় থেকে হঠাৎ কানে আসে গুলির শব্দ। নিমিষেই বৃষ্টির মতো ছুটে আসতে থাকে একের পর এক গুলি। চোখের সামনে দেখলাম, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন সহকর্মী।”

একই পত্রিকায় আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে, “ কিছুদুর যাওয়ার পর পেছন দিক থেকে হঠাৎ গাড়িতে ছুটে আসে গুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগে আমাদের গাড়িতেও গুলি লাগে। জীবন বাঁচাতে সবাই চিৎকার শুরু করি। এভাবে কিছুদুর যাওয়ার প্র দেখি কেবল রক্ত আর রক্ত। ”

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার ফেসবুকে ঘটনার পরবর্তী অবস্থা তুলে ধরে এক পোষ্টে লিখেছেন,
“এসেছিলাম নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে। ভোট বর্জনের মাধ্যমে ক্ষুব্দ প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন শান্তিপূর্ণভাবে। সারাদিন খুব স্বাভাবিক, শান্ত পাহাড়ি জনপদ। সন্ধায় হুট করে রক্তারক্তির খবর! দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে। তিনটি চান্দের গাড়ীতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, হাসপাতালের সিড়ি আর মেঝেতে রক্তের ছটা আর ভেতরে তীব্র আর্তনাদ। পুরো ওয়ার্ডে রক্তাক্ত মানুষ; কিছু মৃত, কিছু আর্ত-চিৎকারেহতবিহ্বল।কান্না, রক্ত, অসহায়ত্ব, মাতম। ৬ জন ততক্ষণে নিথর মৃত। আশংকাজনক ১১ জন ভয়াবহ আশংকাজনক। বাকিরা চিকিৎসারত।“

“ইউএনও স্যার, আমি, আর আরেক ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল দিকবিদিকশুন্য ছুটছি রক্তাক্ত সিড়ি, করিডোর আর ওয়ার্ডে। কাতরদের পাঠাতে হবে হেলিকপ্টারে করে চট্রগ্রাম। তাহলে হয়তো বাঁচবে। আমি পুলিশ সাথে নিয়ে চিৎকার করছি গাড়ীযোগে হেলিপ্যাড এ পাঠাতে। আমাদের গাড়ীতে একটার পর একটা গুলিবিদ্ধ মানুষকে পাঠাচ্ছি। তারপর হেলিপ্যাডের দিকে  যাত্রা। ৬ টি লাশ হাসপাতালে রেখে সবুজ হেলিপ্যাডের মাঠে আমরা। লাইন ধরে শুয়ে থাকা বিক্ষত মানুষ। কারো বুক থেকে, কারও মগজ থেকে, কারো উরু থেকে, কারও ডানা থেকে সস্তা রক্ত ঝরছে। প্রথম দফায় ৬ জনকে উড়ানো হলো। “ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ ২০১৯)

‘মৃত্যুর খুব কাছে থেকে নিজে প্রানে বেঁচে ফিরলেও’, দিনভর যাদের সাথে কাজ করেছেন, চোখের সামনে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছেন না, শিক্ষিকা ইয়াসমিন আক্তার। বাসায় ফিরে তিনি তার স্বামী আর দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে শুধু কান্না করছেন। এখনো ভয়, আতংক তাকে তাড়া করছে; কোন কিছু খেতেও পারছেন না তিনি। তার মতোই আরেকজন শিক্ষিকা সেলীনা বেগমও একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন, এমনকি বাসা থেকেও বের হচ্ছেন না। বস্তুত, কতদিন বা কত বছর লাগবে এই ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে যেতে বা আদৌ ভুলতে পারবেন কিনা তা কোনদিনও হয়ত জানা যাবে না।

ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হবেন, এমন মানুষের সংখ্যা আরো আছে। এমনকি কোন স্মৃতি না থাকলেও এই নৃশংসতার ভয়াবহতা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, এমন মানুষও রয়েছে। যেমন ঘটনায় নিহত আমির হোসেনের ছোট মেয়ে, যার বয়স মাত্র দুই মাস! দুই মাস বয়সী, এক মেয়েটির কোনোমতেই বুঝতে পারা কথা নয় যে, সে এতিম হয়ে গিয়েছে, বা তার বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। দুই মেয়ে আর এক ছেলের সংসারে এক শিক্ষক, সরকারী কর্তব্য পালনে গিয়েছিলেন;  কিন্তু ফিরে আসতে পারেননি।

তবে, পিয়াল দত্তের কপাল সে তুলনায় ভালো বা খারাপ বলাটা কতটা দৃষ্টিকটু হবে বুঝতে পারছি না। কারণ, একই ঘটনায় সে তার বাবা মিহির কান্তি দত্তকে হারিয়েছে। তবে শৌখিন আলোকচিত্রী এই যুবকের কোন কিছু না বুঝতে পারার বয়স অনেক আগেই পার হয়েছে। তাই, একত্রে নির্বাচন ডিউটি পালনে গিয়ে নিজের ক্যামেরায় তোলা বাবার শেষ ছবি, মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলছিলেন, “আর কোনোদিন ছবি তুলতে পারবো না বাবার”। কতটা করুণ, মর্মান্তিক আর হৃদয়স্পর্শী হতে পারে এমন একটা দৃশ্য – আমি কল্পনাও করতে পারি না।

বাঘাইছড়ির নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে পাহাড়ের অন্যান্য বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন মহল থেকে দেখানো হয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। যথারীতি পাহাড়ের অধিবাসীদের একাংশ এই ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মানব বন্ধন, প্রেস রিলিজ, হরতাল, মিছিল ইত্যাদি যেমন লক্ষ্যণীয়; তেমনি পাহাড় নিয়ে সরব থাকেন, এমন কিছু পরিচিত মুখের মৌন্যতাও দৃস্টি এড়ায়নি। সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ কেউ ( অমানুষ ?) এই মৃত্যুতে উল্লাস পর্যন্ত প্রকাশে দ্বিধাবোধ করেনি।

বহূল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো এই ঘটনাকে পর্যাপ্ত গুরুত্বের সাথে কাভার করছে। একই ধারা চোখে পড়েছে টিভি মিভিয়াগুলোতে – সংবাদের পাশাপাশি এই ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানীমূলক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রায় সব টিভি চ্যানেলেই প্রচার করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া যথারীতি সর্বক্ষণ এই ঘটনা নিয়ে গরম হয়ে আছে।

আহতদের উদ্ধার যে দ্রুততা এবং যত্নের সাথে করা হয়েছে, দেশের সাধারণ কোন নাগরিকের জন্যে নিকট অতীতে এমনটি চোখে পড়েনি। অতি দ্রুততার সাথে রাতেই হেলিকপ্টারে করে ১৮ জনকে চট্টগ্রাম সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে ৭ জনকে রাতেই আবার হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উদ্ধার কর্মকাণ্ডের দক্ষতার পাশাপাশি, পাহাড়ের সকল শ্রেণীর অধিবাসীদের প্রতি সেনাবাহিনীর আন্তরিকতাও প্রমাণিত হয়েছে, আরেকবার।

ইতোমধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অভিযান জোরদার করেছে। নির্বাচন কমিশন ৭ সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আর, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মত করে এই ঘটনার পিছনে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদসহ অনেকেই এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবী জানিয়েছেন।  ব্যতিক্রমী হলেও ঢাকায় বাঙালীদের দেখা গেছে প্রতিবাদে মানব বন্ধন করতে, যা সচরাচর পাহাড়িদেরকে করতে দেখা যায়। তবে, অনেক ছোট ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে পাহাড়ি সংগঠনগুলোকে প্রতিবাদের আয়োজন করতে দেখা গেলেও এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তেমন কিছু চোখে পড়েনি।

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আপন ভাই বা বোন হারানো কারো সজল দৃষ্টি, সন্তান হারানো ক্রন্দনরত পিতা-মাতার কান্না অথবা মা কিংবা বাবা হারানো এতিম সন্তানের আহাজারি – এর সবকিছুই হয়ত আমরা কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে যাব। যেমনটি ঘটেছে, অতীতের অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। যেমন, গত ১৫ মাসেই ৫৮ জন নিহত হয়েছে (প্রথম আলো, ২০ মার্চ ২০১৯); পার্বত্য চুক্তির পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৭৫০ জনের অধিক ব্যক্তি। এই প্রতিটি মৃত্যুর সাথে জড়িত আতংক, আহাজারি, দুর্দশা কিংবা কষ্ট আর বেদনা ক্রমেই বেড়ে চলছে, কমার কোন লক্ষণ আপাতত চোখের সামনে নেই।

এত বড় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কারা ঘটিয়েছে, বা কেন ঘটেছে এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ? প্রশ্ন চেপে রাখা আরো কষ্টকর হয়ে দাড়ায় যখন প্রায় তিনদিন পার হলেও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়না। যদিও এই বিষয়ে আলোকপাত করার মত পর্যাপ্ত সুযোগ বা তথ্য-উপাত্ত হাতে নেই। তবে, বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল আরসোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ইতোমধ্যেইকিছু কিছু বিষয় প্রায় সকলেই জানতে পেরেছে ।

পার্বত্য নিউজ এ  বিষয়ে ‘বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ড: সন্দেহের তীর ইউপিডিএফের দিকে’ শিরোনামে গত ২১ মার্চ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকেও ইতোমধ্যেই তথ্য এবং অনুমান মিশ্রিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

বিভিন্ন সুত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাঘাইছড়ি, বাঘাইহাট এবং মারিশ্যা এলাকায় গত এক বছরে মোট ৮ টি হত্যাকান্ডের ঘটনায় ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। তন্মধ্যে ২৮ মে ২০১৮ তারিখে করল্যাছড়ি এলাকায় প্রসীতপন্থি  ইউপিডিএফ  এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র দলের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনায় ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এছাড়া আরেকটি ঘটনায় ৪ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে জেএসএস (মুলদল) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মারিশ্যায় জেএসএস (এম এন লারমা) দলের সদস্য বসু চাকমাকে হত্যা করে।

এছাড়াও গত এক বছরে এই এলাকাসমুহে ১৫টি অপহরনের ঘটনায় মোট ২০ জনকে অপহরণ করা হয়। অপহরনের ঘটনার মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রিমি চাকমার ঘটনা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। উল্লেখ্য, ০১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে, পরিসংখ্যান বিভাগের ১৩ জন ছাত্রছাত্রীর একটি দল সাজেক যাওয়ার সময় প্রসীতপন্থি  ইউপিডিএফ  এর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাকে অপহরণ করে। অবশ্য, নিরাপত্তা বাহিনীর দ্রুত এবং ব্যাপক তৎপরতায় পরবর্তীতে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

শুধু হত্যা এবং অপহরনই নয়, বাঘাইছড়ি  এবং মারিশ্যা এলাকায় গত এক বছরে বিভিন্ন সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে প্রায় দু’ডজনের বেশি গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যে সশস্ত্র দলগুলো প্রায় দশটির বেশি ঘটনায় গুলি বর্ষণ করে নিজেদের শক্তিমত্তা জাহির করে।এই সকল ঘটনায় সবগুলো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র সংগঠন জড়িত থাকলেও সাধারনভাবে এক পক্ষে ছিল প্রসীতপন্থি  ইউপিডিএফ  আর অন্য পক্ষে ছিল জেএসএস (এম এন লারমা) ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। জেএসএস মুলদল কিছু ঘটনায় জড়িত থাকলেও প্রায় সবগুলোতেই প্রসীতপন্থি  ইউপিডিএফ   জড়িত ছিল। মুলতঃ প্রসীতপন্থি  ইউপিডিএফ   এর আধিপত্য  এই এলাকায় বেশি বলেই এমনটি ঘটেছে। অন্তত, বিভিন্ন ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণে সেটাই প্রতীয়মান হয়।

যার প্রতিফলন ঘটে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি’র বক্তব্যেও, যেখানে তিনি বলেছেন,
“যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে, সেটা ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা। সুতরাং, ইউপিডিএফের এই ঘটনা ঘটানোর সম্ভাবনা বেশি।” (পার্বত্য নিউজ, ২১ মার্চ, ২০১৯)।

মজার ব্যাপার হলো, উপজেলা নির্বাচনের বর্তমান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এক সময়ে জেএসএস এর রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী ছিল। তবে সুদর্শন চাকমা জেএস এস (মূল দল) ছেড়ে বর্তমানে জেএসএস (এম এন লারমা) যারা সংস্কারপন্থী নামেই বেশি পরিচিত, তাদের সাথে সম্পৃক্ত। এই দলের ব্যানারে সে ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল। অতীত অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনী তাকে গ্রেফতার করেছিল।

অন্য প্রার্থী বড় ঋষি চাকমা ছাত্র জীবন থেকেই জেএসএস এর সশস্ত্র দলের সাথে জড়িত ছিল। অভিযোগ রয়েছে যে, সে এখন নিজেই  সশস্ত্র দল নিয়ন্ত্রণ করে। বাঘাইছড়ি উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান বড় ঋষি, ২০১৬ সালের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট মুকুল হত্যা মামলা এবং ২০১৯ সালের বসু চাকমা হত্যা মামলায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ফেসবুকে তার একটি ছবি অনেকেই শেয়ার করেছে যেখানে তাকে হাসিমুখে তিনটি একে-৪৭ নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়।

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেএসএস মুলদলের সাথে প্রসীতপন্থী  ইউপিডিএফ   এর সমঝোতার কারণেই বাঘাইছড়িতে নিজেদের আধিপত্য থাকা সত্বেও তারা উপজেলা নির্বাচনে জেএসএস মুলদলের প্রার্থীকে সমর্থন করে। এর পাশাপাশি নিজেরা কোন প্রার্থীও দেয়নি। এমনকি বড় ঋষি’র পক্ষে ফেসবুকে প্রচারণার পাশাপাশি ভয় ভীতি প্রদর্শনেরও অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে।

জানা যায়, নির্বাচন ঘিরে শঙ্কার কারণে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল। আর, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রস্তুতির কারণে অনেক জায়গাতেই সশস্ত্র  সন্ত্রাসীরা নির্বাচনের দিন নিজেদের পরিকল্পনা মোতাবেক কর্মকাণ্ড করতে ব্যর্থ হয়। তাই, নির্বাচনে নিজেদের আধিপত্যপূর্ণ এলাকায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতানোর জন্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করা সত্বেও পরিস্থিতি নিজের অনুকুলে নয় বুঝতে পেরে,বর্তমান চেয়ারম্যান বড় ঋষি চাকমা নির্বাচন চলাকালেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দেয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাঘাইছড়ির ঘটনাকে আঞ্চলিক সমস্যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

আপাতদৃষ্টিতে, যে প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সশস্ত্র সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা এবং অতীতের কিছু ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ বিবেচনায় বাঘাইছড়ির ঘটনায় জেএসএস (মূল) এর দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তোলা সহজ হচ্ছে। তবে ঘটনাস্থল এবং আশেপাশের সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনাবলি এবং পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র দলগুলোর আধিপত্য বিবেচনায় প্রসীতপন্থি ইউপিডিএফ এর দিকেও অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন, সঙ্গত কারণেই। বলাই বাহুল্য, সব কটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলই এই ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। যেই জড়িত থাকুক না কেন, অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি নিশ্চিত করতে করতে হবে পাহাড়ে যেন আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে।

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক


মাহের ইসলামে আরো লেখা পড়ুন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বাঘাইছড়িতে হত্যা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন