ইউপিডিএফ রাঙ্গামাটিতে ঘাঁটি হারাচ্ছে নাকি নির্বাচনী সমঝোতা?

bow
আলমগীর মানিক, রাঙামাটি : ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভোটের হিসাব মিলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস এবং ইউপিডিএফ’র মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক থাকার পরও নির্বাচনে ইউপিডিএফ’র  নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তা অন্যদিকে সরকার দলের জাঁদরেল প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল ব্যবধানে জেএসএস প্রার্থীর অভাবনীয় জয় নির্বাচন বিশ্লেষকদের দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় দলীয়  অবস্থান কি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে? নাকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন সমঝোতা হয়েছে আজন্ম শত্রু এই দুই সংগঠনের মধ্যে?

১৯৯৭ সনের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জনসংহতি সমিতি থেকে বের হয়ে আসা বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী মিলে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে গঠন করে ইউপিডিএফ। তারা সরকারের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস নেতা সন্তু লারমাকে জাতীয় বেইমান আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলে দুর্বার সশস্ত্র আন্দোলন। এর পর থেকেই শুরু পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাতৃঘাতী সংঘাত। এই সংঘাতে ইতোমধ্যে শত শত পাহাড়ি মায়ের বুক খালি হয়েছে। সংগঠন দুটির বিরুদ্ধে পরস্পরের নেতাকর্মীদের হত্যা গুম অপহরণের অভিযোগ এখনও চলছে থেমে।

কিন্তু এর মধ্যেই নির্বাচনকে সামনে রেখে এক দলের নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া এবং অন্য দলের প্রার্থীর বিপুল জয় নিয়ে পাহাড়ারের রাজনীতি নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন তাদেরকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে অনেক কিছুই। ধারণা করা হয় বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী সমৃদ্ধ সংগঠন ইউপিডিএফ। বিশেষ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে যে সব এলাকায় সেখানে বলতে গেলেই তাদের কথাই শেষ কথা। যার ফলে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বাতিল হয়ে যাওয়ায় ইউপিডিএফ না ভোট দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এবং তারা তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে সারা দেশের মধ্যে না ভোটের রেকর্ড করেছিল রাঙ্গামাটিতে। তখন ৩২০৬৭টি না ভোট কাস্ট করে ইউপিডিএফ রাঙ্গামাটিকে তাদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে প্রমাণ করেছিল। কিন্তু পাঁচ বছরের এই নির্বাচনে এসে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে সুযোগ করে দেওয়ায় হিসাব মিলাতে পারছে না কেউ। তাহলে কি প্রভাবশালী এই সংগঠনটি রাঙ্গামাটিতে দিন দিন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে? পরাজিত হয়েছে জেএসএস’র কাছে?  

সদ্য সমাপ্ত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি জেলার একমাত্র সংসদীয় আসনে ইউপিডিএফ এর কেন্দ্রীয় নেতা সচিব চাকমার করুণ পরাজয়ের পর এই প্রশ্ন এখন সকলের মুখে মুখে। বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি হতে ইউপিএফ যেখানে নিজেদের পক্ষে উল্লেখ যোগ্য ভোট কাস্ট করতে পেরেছিল সেখানে এইবার মাত্র ১২৪৩টি ভোট পেয়ে জামানত হারানোর কারণ কী? তাহলে কি ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী নামমাত্র নির্বাচনে অংশ নিয়ে অন্য কোন স্থানীয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে সমর্থিত দিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়কে নিশ্চিত করেছে?

২০০১ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি আসনে ইউপিডিএফ প্রার্থীর সম্মানজনক ভোটপ্রাপ্তি এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের প্রার্থী না থাকায়  ৩২ হাজারেরও বেশি না ভোট কাস্ট হয়েছিল। এই বিচেনায় এইবারও ধারণা করা হয়েছিল ইউপিডিএফ এর শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত জেলার কয়েকটি উপজেলায় এবারও ইউপিডিএফ সমর্তিত প্রার্থী সচিব চাকমা উড়োজাহাজ প্রতীক নিয়ে সম্মানজনক ভোট অর্জন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোট গণনার পর দেখা যায় মোট ভোটের মাত্র ১ শতাংশের সামন্য বেশি ভোট পেয়েছে এই প্রার্থী, যেখানে ইউপিডিএফ এর প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমার্থিত প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার হাতি প্রতীকে ৯৬,২৩৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। পাশাপাশি অপর আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) সমর্থিত সুধাসিন্ধু খীসা ২৪,৩৫২ ভোট পেয়ে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছেন।

ইউপিডিএফ এর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলা। এছাড়া সদর উপজেলা, কাউখালী উপজেলা, বাঘাইছড়ি উপজেলা, লংগদু উপজেলা, কাপ্তাই উপজেলার একাধিক এলাকায় রয়েছে তাদের শক্ত অবস্থান। তাই এসব উপজেলায় ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী সচিব চাকমার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পাওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনী ফলফলে দেখা যায় ইউপিডিএফ এর শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত নানিয়রারচর উপজেলায় ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৪১৩ ভোট। অথচ এই উপজেলায় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এমএনলারমা গ্র“পের সুধাসিন্ধু খীসার বই প্রতীক সর্বোচ্চ ৭৬৬৭ ভোট এবং জেএসএস প্রার্থীর হাতি প্রতীক ২৯৯০ ভোট পেয়েছে। ইউপিডিএফ এর অপরাপর শক্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে রাঙ্গামাটি সদরে ১৩৩ ভোট, কাউখালীতে ১৪৯ ভোট, বাঘাইছড়িতে ৩২২ ভোট, লংগদুতে ৬৯ ভোট পায় উড়োজাহাজ প্রতীক।

রাঙ্গামাটি জেলায় সংসদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ প্রার্থীর কেন এই করুণ পরাজয়? এর মাদ্যমে কি এই শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের শক্তি কমে আসার সংকেত রয়েছে? নাকি এটি কোন নির্বাচনী সমঝোতা? নাকি স্থানীয় প্রধান দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মদ্যে ঐক্যে পৌঁছানোর প্রাথমিক সংকেত?

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেককদের ধারণা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান  ২টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি এবং ইউপিডিএফ এর মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত এখানে এই ২টি দলের সংঘর্ষে উভয় দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এক দল অপর দলকে নিষ্দ্ধি করার দাবিতে সোচ্চার। এই অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম  জন সংহতি সমিতি সমর্থিত প্রার্থী চূড়ান্ত বিজয় নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে এই জেলার প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করেছেন, সেখানে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা অবাক করার মতো বিষয়।

অনেকের ধারণা, এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারকে পরাজিত করার জন্যই ইউপিডিএফ’র এটি একটি কৌশল। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই এই কৌশল নির্ধারিত হয়েছে। আবার অনেকের ধারণা ইউপিডিএফ এর শক্তিশালী অবস্থান দখল করে নিচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী গ্র“প হিসেবে পরিচিত এমএনলারমা গ্র“প। যার ফলে এতদিন যেখানে ইউপিডিএফ’র ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল সেসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে এমএন লারমা গ্রুপের হাতে। এসব এলাকার ইউপিডিএফ এর সমর্থকরাও মিশে যাচ্ছে নতুন সংগঠন জেএসএস (এমএন লারমা)’র সাথে, যার প্রমাণ ইউপিডিএফ এর শক্তিশালী ঘাঁটিগুলোতে এমএনলারমা গ্র“প সমর্থিত সুধাসিন্ধু খীসার উল্লেখ যোগ্য ভোট প্রাপ্তি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, জেএসএস, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন