আ’লীগ ঠেকাতে জেএসএস-ইউপিডিএফ একাট্টা

hill-politics02

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিহিংসা আর সংঘাতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখা দিয়েছে। পাহাড়ে সক্রিয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী যার যার স্বার্থ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এখন মরিয়া। এর ফলে ছোট বড় অপরাধ বেড়েই চলেছে। খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি গত দেড় দশকের মধ্যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সশস্ত্র তৎপরতা। যা অশান্ত করে তুলেছে পাহাড়কে। পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির রাজনীতির এই সংকটের চিত্র নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হল :

আতিক রহমান পূর্ণিয়া, বান্দরবান থেকে ফিরে:

পাহাড়ের রাজনীতির ঘোলা জলে হঠাৎ করেই শত্রুতা ভুলে এক হয়েছে শান্তিচুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও বিপক্ষের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ঠেকাতেই এই দুই শক্তির এক হওয়া। জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে পাহাড়ের রাজনীতির এখন সরল হিসাব হল- যেখানে যেভাবে পারো আওয়ামী লীগ ঠেকাও।

পাহাড়ি তিন জেলায় সরেজমিন ঘুরে ও বিভিন্ন শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে পার্বত্য রাজনীতির এই মেরুকরণের কথা জানা গেছে। আওয়ামী লীগ, জেএসএস ও ইউপিডিএফের নেতারা একবাক্যে এই নতুন মেরুকরণের কথা স্বীকারও করেছেন।

শান্তিচুক্তির পক্ষের সংগঠন জেএসএস, বিপক্ষের সংগঠন ইউপিডিএফের সশস্ত্র রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দখলদারিত্ব-পাহাড়কে অশান্ত করে তুলছে।

এই তিন শক্তির অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঘটছে একের পর এক সংঘাত-সংঘর্ষ। এ সুযোগে একটি অংশ বিপুল পরিমাণ অবৈধ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ তৈরি করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অন্যমিডিয়া

পার্বত্য তিন জেলায় অনেকটাই ক্ষমতার ভাগাভাগি করে নিয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফ। এই সমঝোতাকে অঘোষিত অস্ত্র বিরতির ধারাবাহিকতা বলছেন এই দুই সংগঠনের নেতারা। জেএসএস শান্তি চুক্তির পক্ষে থাকলেও ইউপিডিএফ শান্তি চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে অনেকটাই সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি এর ব্যতিক্রম।


এই সিরিজের প্রথম কিস্তি পড়ুন নিচের লিংকে:

আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করতে জেএসএসের প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র ক্যাডার তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করেছে


খাগড়াছড়িতে পাহাড়ের আঞ্চলিক অনিবন্ধিত সংগঠন ইউপিডিএফ-এর প্রভাব জেএসএসের চেয়ে বেশি। অন্য দুই পার্বত্য জেলার তুলনায় খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি দৃশ্যমান। ইউপিডিএফের প্রভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সেখানে প্রায় অসহায়। যার প্রমাণ মেলে সর্বশেষ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে।

ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদগুলোতে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাসহ সব ক’টি উপজেলা সদরে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে চলে ইউপিডিএফের একক প্রভাব। আর এ বিষয়টিও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের জন্য। ফলে মারমুখি হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। যা আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-কে।

অভিযোগ আছে ইউপিডিএফের আন্দোলনের দাবি মোতাবেক ‘জুম্মল্যান্ড’ এর আদলে পরিচালিত হয় পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির বেশিরভাগ দুর্গম এলাকা। ইউপিডিএফ তাদের আদিম জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি মেনে মূলত জুমচাষ সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি ধরে রেখে একটি জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার কথা বলে। যার আলাদা স্বাতন্ত্র্য সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক অবস্থান থাকবে। যদিও ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার সময়ে পুরোপুরিই একটি স্বাধীন পার্বত্য এলাকা গঠনের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছিল। পাহাড়ের আঞ্চলিক এ সংগঠনটির বিরুদ্ধে সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা দিয়ে ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে ।

ইউপিডিএফের কাছে অত্যাধুনিক অনেক সমরাস্ত্র থাকার অভিযোগ অনেক দিনের। গোয়ান্দা রিপোর্টেও পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবসাসহ সীমান্ত অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অরক্ষিত আন্তর্জাতিক সীমানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে তৎপর হয়েছে।

অন্যদিকে ইউপিডিএফের অস্তিত্ব থাকলেও জেএসএসের প্রায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে। যদিও এই দুই জেলাতেই জেএসএসের দুইটি উপদল রয়েছে। জেএসএসও সম্প্রতি এই দুই জেলায় তাদের সশস্ত্র ক্যাডারগ্রুপকে সক্রিয় করে তুলেছে বলে প্রশাসনের কাছে সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে। আবার জেএসএসের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন চাঁদাবাজির তথ্য আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দাদের কাছে।

একইসঙ্গে পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রায় দেড়যুগ পেরুতে গেলেও এর আশানুরূপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংগঠনটির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়েছে। যদিও এর আগে সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রাখার কারণে পাহাড়ে ‘আদিবাসীদের’ সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল জেএসএসের। অন্যদিকে এই সুযোগে ইউপিডিএফ তাদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করলেও প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের মুখে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি।

এ অবস্থায় নিজেদের অভিন্ন স্বার্থে হাতে হাত মিলিয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফ। আর আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতারা অভিযোগ করেছেন এই দুই সংগঠন (জেএসএস ও ইউপিডিএফ) সশস্ত্র ক্যাডার দিয়ে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনের প্যারালাল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, তাদেরকে হত্যা, গুম, খুন বা অপহরণের টার্গেট করে প্রতিনিয়ত কাজ করছে জেএসএস ও ইউপিডিএফ।

যদিও এই দুই সংগঠনই তাদের বিরুদ্ধে করা আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেছেন, আওয়ামী লীগ অকারণে দখলদারিত্ব বজায় রাখতে তাদের দুই সংগঠনের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করছেন বা জেলে পাঠাচ্ছেন।

বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ক্যা শৈ হ্লা দাবি করেন, জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর নেতারা মিথ্যা কথা বলছে। তার অভিযোগ, অস্ত্র আর চাঁদাবাজি ছাড়া জেএসএস ও ইউপিডিএফের এখন আর কোনো কর্মসূচি নাই। ঐ দুই সংগঠনের হুমকির মুখে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রাতে ঘরে থাকতে পারেন না বলেও ক্যা শৈ হ্লার অভিযোগ।

অন্যদিকে জেএসএসের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র এবং সহতথ্য ও প্রচার সম্পাদক (সন্তু লারমা অংশের) সজিব চাকমা স্বীকার করেন, চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে যে সংঘাত এখন তা এক প্রকার বন্ধ। ইউপিডিএফের সাথে তাদের সমস্যা মিটে গেছে বলেও সজিব চাকমা দাবি করেন।

যদিও জেএসএসের অপর অংশের সভাপতি সুধা সিন্দু চাকমা দাবি করেছেন, ইউপিডিএফ কি করে না করে তা তিনি জানেন না এবং তার কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে জেএসএস ও ইউপিডিএফের ঐক্য হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে ইউপিডিএফের মুখপাত্র নিরন চাকমার সাথে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে গত মাসের শেষ সপ্তাহে পার্বত্য বান্দরবানের একটি রেস্টুরেন্টে ইউপিডিএফের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমরা এখনও নৈতিকভাবে শান্তিচুক্তির বিরোধী। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় জেএসএসের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে শক্তি ক্ষয় করতে চান না।

উল্লেখ্য, গ্রেফতার এড়াতে ইউপিডিএফের বেশিরভাগ দায়িত্বশীল নেতাই অধিকাংশ সময় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিয়ে থাকেন।

শুক্রবার পড়ুন তৃতীয় পর্ব

সূত্র- পরিবর্তন ডটকম

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন