আলীকদমে মাতামুহুরী রেঞ্জে বেপরোয়া কাঠ পাচার অব্যাহত
আলীকদম (বান্দরবান) প্রতিনিধি:
লামা বন বিভাগের আওতাধীন মাতামুহুরী সংরক্ষিত রেঞ্জে সেগুনসহ মূল্যবান প্রজাতির কাঠ পাচার অব্যাহত থাকলেও জুমিয়াদের মামলায় জড়িয়ে হয়রানীর অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাঠচোরদের সাথে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাত্ম হয়ে কাঠ পাচার অব্যাহত রেখেছে। এ নিয়ে মামলার শিকার ক্ষতিগ্রস্ত জুমিয়া ও এলাকাবাসী ক্ষোভে ফুঁসছেন কাঠচোর ও বন বিভাগের বিরুদ্ধে।
মাতামুহুরী রিজার্ভের বুজি পাড়ার পায়া মুরুং ও অংলে মুরুং জানান, জন্মলগ্ন থেকে বন জঙ্গলেই তাদের নিবাস। গাছ পাচারের সাথে তারা কোনওভাবে সম্পৃক্ত নয়। সংরক্ষিত এলাকায় গাছ কর্তন করে বহিরাগত কাঠুরিয়া। গাছ পাচারে সহযোগিতা করে বন বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। তাদের আদি পেশা জুম চাষ। বংশপরম্পরায় জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। তারা অভিযোগ করেন, মাতামুহুরী রেঞ্জের বনকর্মীদের দাবীকৃত চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় জুমিয়াদের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি বন মামলা দায়ের করে মাতামুহুরী রেঞ্জ কর্তৃপক্ষ।
মামলার এজাহার সুত্রে জানা যায়, সরকারী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবৈধ প্রবেশ পূর্বক ২০০৩ সনে সৃজিত সেগুন গাছ কর্তন করে পাচারের চেষ্টা করায় এবং জুম চাষ করে বনের ক্ষতি করায় গত ৫ মে সি.আর ৬৪/১৩, সি.আর ৬৫/১৩ ও সি.আর ৬৬/১৩ মামলা রুজু হয়। এ তিন মামলায় ১২ জন জুমিয়াকে আসামী করে মাতামুহুরী রেঞ্জ। মামলায় ১৯২৭ সনে প্রণীত ২০০০ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ বন আইনের ২৬ (১ক), ৬৩ (ক), ৪১ ও ৪২ ধারার অভিযোগ আনা হয়।
জন সংহতি সমিতির (জেএসএস) আলীকদম উপজেলা সাধারণ সম্পাদক চাহ্লামং মার্মা বলেন, স্থানীয় জুমিয়াদের বিরুদ্ধে যে ধারায় অভিযোগে এনে বন বিভাগ মামলা করেছে তাতে শংকিত হয়ে পড়েছে রিজার্ভ এলাকার বাসিন্দারা। তিনি বলেন, বর্তমানে মাতামুহুরী রিজার্ভ অভ্যন্তরের সহস্রাধিক করাতিদল অবৈধভাবে গাছ কর্তন ও পাচার করে আসছে। বাবু পাড়া চেক পোস্টে কর্মরত মাতামুহুরী রেঞ্জর বনকর্মীরা ফুটপ্রতি উৎকোচ নিয়ে দিনে রাতে সেগুনসহ মূল্যবান প্রজাতির গাছ পাচারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। অথচ বনকর্মীরা নিজেদের কর্মদক্ষতা প্রমাণের জন্য স্থানীয় জুমিয়াদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দিয়ে হয়রানী করে চলেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান রেঞ্জ কর্মকর্তা রেজাউল করিম যোগদানের পর নানা দুর্নীতেতে জড়িয়েছেন। তার ইন্ধনে কাঠ পাচার অতীতের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গত অর্থবছরে জুমিয়াদের দিয়ে সামাজিক বনায়নের জঙ্গল পরিস্কার করানো হলেও অদ্যাবধি কোন পারিশ্রমিক দেননি। পরে এসব টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রক্ষা করেননি। জুমিয়াদের পারিশ্রমিকের অর্থ আত্মসাত করেছেন। জুমিয়ারা প্রাপ্য মজুরী দাবীর পর থেকে রেঞ্জ কর্মকর্তার ইন্ধনে সাবেক বিট কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জুমিয়াদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সৃজন করেছেন। কাঠ পাচারের কথিত অভিযোগে সৃজিত মিথ্যা মামলায় জুমিয়ারা জেলে যায়। অথচ রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তা উপজেলা সদরের কাঠচোরদের সাথে দিব্যি দহরম-মহরম করে চলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইতোপূর্বে সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে পাচারের বিরুদ্ধে রেঞ্জার ও বিট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত বছরের ৭ অক্টোবর স্থানীরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বন বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। অথচ অদ্যাবধি কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা কুশ কুমার বৈদ্য অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন।
জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯২০ সালে আলীকদম উপজেলায় প্রায় ১ লক্ষ ৩ হাজার একর পাহাড়ি ভূমিকে বনায়নের আওতায় এনে রিজার্ভ ঘোষণা করেন। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে তা একটানা ১৯৫২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বনায়ন চলে। বনায়নের ফলে সৃষ্ট হয় মাতামুহুরী রিজার্ভ। বিশাল আয়তনের এ রিজার্ভে ১৩ হাজার একর ভূমিতে শুধু সেগুন বৃক্ষ সৃজন করা হয়। ২০০৩ সালের পর থেকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচীর আওতায়ও আবারো সেগুনসহ নানা প্রজাতির বনায়ন করা হয়। কিন্তু কাঠচোরেরা বনকর্র্মীদের সাথে যোগসাজশ করে প্রতিনিয়ত সেগুন, গামারী, জারুল, গর্জন, চাপালিশ, চাঁম্পাফুল ও তেলসুরসহ মূল্যবান প্রজাতির বৃক্ষ উজাড় করে চলেছে অভিযোগ উঠেছে।
জানতে চাইলে মাতামুহুরী রেঞ্জ কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, কিছু জুমিয়া সামাজিক বনায়নের জঙ্গল পরিস্কার করেছে। বরাদ্দ না আসায় তাদের পারিশ্রমিক এখনো দেয়া হয়নি। গাছ পাচারের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলে এটি গতানুগতিক ঘটনা।