আলীকদমে তামাক চাষে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরা শক্তি : জিম্মি চাষীরা
মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান):
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় তামাক চাষে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি, পানি দুষণ ও মাটির উর্বরাশক্তি নষ্ট হলেও দেখার কেউ নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, তামাক কোনো ফসল নয়। কৃষক নিজের পছন্দে কোন ধরনের তামাক পাতা চাষ করবেন, তাও নির্ধারণ করতে পারেন না। কোম্পানীর নির্দিষ্ট করে দেওয়া ভার্জিনিয়া, বার্লি বা মতিহারি পাতারই চাষ করতে হবে। কোম্পানি তাঁকে বীজ, সার, কীটনাশক, পলিথিন থেকে শুরু করে সব সুবিধায় দেয়। তবে তা ফ্রি নয়। কোম্পানীর করিৎকর্মা স্টাফরা সবই লিখে রাখবে। তামাক কোম্পানীর ক্রয় কেন্দ্রে পৌঁছার সাথে সাথেই দাম কেটে রাখা হবে।
চাষীরা তামাক পাতা পোড়ানের জন্য তন্দুরে যত ফলদ-বনজ গাছ আছে নির্বিচারে কেটে লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করবে। সেটি হতে পারে আম-জাম-কাঁঠালের মতো ফলদ বৃক্ষ। কিংবা আমলকীর মতো অমূল্য ওষুধী গাছও। তামাকের তন্দুরে এসবের কোনো মূল্য নেই।
তামাকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি:
তামাকে নিকোটিন নামক বিষাক্ত রাসায়নিক রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, তামাক ক্ষেতে অতিরিক্ত ইউরিয়া সার, নানা ধরণের বিষ ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। তামাকের বিষাক্ত নিকোটিনের প্রভাবে শিশুরা শ্বাসকষ্ট, রক্তনালী সংকোচন, হাঁপানি ও বয়স্কদের হৃদরোগ, চর্মরোগ, ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়াও বার্জাস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা আছে। গর্ভবর্তী মহিলারা আক্রান্ত হলে অনাগত শিশুদের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
প্রতিবছর তামাক ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের ১২ লাখ মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সার, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসজনিত রোগের মতো ৮টি মারাত্মক কঠিন রোগ ও তামাকজনিত অন্যান্য রোগে আক্রান্তের জন্যও তামাক সেবন দায়ী। আর এসব রোগীর মাত্র ২৫ শতাংশ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
তামাক সেবন শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের উপরও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে যা জাতীয় অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
কোম্পানীগুলো উৎপাদনের জন্য ঋণ দিলেও কৃষকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে ‘মাস্ক ও গ্লাভস্’ বিতরণ করে না। কীটনাশক প্রয়োগের সময় যাতে বিষক্রিয়ায় চাষীরা আক্রান্ত না হন সেজন্য মাস্ক ও গ্লাভস অত্যন্ত প্রয়োজন। চাষীদের স্বাস্থ্যগত দিক চিন্তা করে কোম্পানীগুলোর এ ধরণের প্রচারণাও নেই বলে জানা গেছে।
মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট:
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, একই জমিতে বারবার তামাক চাষের ফলে সে জমিতে অন্য ফসল উৎপাদন আশংকাজনক হারে কমে যায়। তামাক চাষ মাটির প্রাণশক্তি একেবারেই নিঃশেষ করে দেয়।
আলীকদমের সাবেক কৃষি কর্মকর্তা আফসারূজ্জামান জানান, আলীকদমের অধিকাংশ মাটি বেলে-দোঁআশ থেকে এটেল-দোঁআশ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকে এখানকার মাটি পাহাড় ধসে, জৈব-রসায়নিক প্রক্রিয়া ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নানাবিধ খনিজ পদার্থের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার মাটির উর্বরতা সন্তোষজনক নয়। গুণাগুণ সম্পন্ন মাটিতে কমপক্ষে শতকরা ২ ভাগ জৈব পদার্থের প্রয়োজন থাকলেও এখানকার কৃষি জমিতে রয়েছে মধ্যম মানের মাত্র ১.৭২-২.৪৩ ভাগ জৈব পদার্থ।
কৃষকরা কৃষি জমিতে উপযুক্ত শস্য বিন্যাস না করে তামাক চাষ করে চলেছে। ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় এখানকার বিস্তির্ণ কৃষি জমিতে সবুজ সার, সরিষা ও ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদন হতো। যার বেশীরভাগ এখন তামাক চাষের কবলে।
তাঁর মতে, তামাকের কারণে জমিতে অসম মাত্রায় ইউরিয়া সারের উদ্বেগজনক প্রয়োগ, বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ বালাইনাশকের এলাপাতাড়ি ব্যবহার চলছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও কোম্পানীগুলোর দৌরাত্ম কৃষকদের তামাক চাষে ঠেলে দিয়েছে।
(আগামীকাল পড়ুন: আলীকদমে তামাকে চাষের প্রভাব নদীতে : আইনের বালাই নেই)
এই সিরিজের পূর্বের রিপোর্টগুলো: