আনারস বাগান কেটে দেয়ার অভিযোগ আসলে উছিলা মাত্র- ড. স্বপন আদনান

1-Dhaka sonhoti somabesh, 19.12

স্টাফ রিপোর্টার:

সিএইচটি কমিশনের সদস্য ও গবেষক স্বপন আদনান বলেন, তথাকথিত শান্তিচুক্তি ধোঁকা দেয়ার সামিল, তাতে পাহাড়ে সমস্যার সমাধান হয় নি। ভূমি কমিশনের কথা লেখা আছে, তার কাজ পাহাড়িদের ভূমি ফিরিয়ে দেয়া। অথচ তা অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। সেকারণে চুক্তির পরও ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। ভূমি বেদখলে এখন বিভিন্ন ব্যক্তিগত কোম্পানিও জড়িয়ে পড়েছে।

স্বপন আদনান বলেন, তথাকথিত শান্তিচুক্তি ধোঁকা দেয়ার সামিল, তাতে পাহাড়ে সমস্যার সমাধান হয় নি। ভূমি কমিশনের কথা লেখা আছে, তার কাজ পাহাড়িদের ভূমি ফিরিয়ে দেয়া। অথচ তা অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। সে কারণে চুক্তির পরও ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। ভূমি বেদখলে এখন বিভিন্ন ব্যক্তিগত কোম্পানিও জড়িয়ে পড়েছে। গবেষক স্বপন আদনান সেনা-বাঙালীদের ভূমি বেদখলদারিত্বের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।

স্বপন আদনান আরও বলেন, ভূমি বেদখলের জন্য নানা উছিলা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আনারস বাগান কেটে দেয়ার অভিযোগও আসলে উছিলা মাত্র। অপহরণ নাটকও তো সাজানো হয়েছিল। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের টিমের সদস্য হিসেবে রাঙ্গামাটি সফরে গিয়ে আক্রান্ত হবার অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, থেমে গেলে হবে না।

শুক্রবার বিকেল সোয়া তিনটায় ঢাকায় শাহবাগ জাতীয় যাদুঘরের সামনে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগের  প্রতিবাদে এক সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বগাছড়ি থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলও যোগ দেয়। জ্ঞানালোক ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যানার নিয়ে সংহতি সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। ঢাকাস্থ পাহাড়ি শিক্ষার্থী পেশাজীবী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী সংহতি জানিয়ে উপস্থিত হন।

ইউপিডিএফের অঙ্গ সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ)-এর সভাপতি মাইকেল চাকমার সভাপতিতে সংহতি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর আনু মহাম্মদ, নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার সমন্বয়ক জাফর হোসেন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুর রহমান, প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, আইনজীবী সাদিয়া আরমান, বাসদ-মার্কসবাদী নেতা ফখরুদ্দিন আশীষ, ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক শান্তুনু সুমন, জ্ঞানালোক ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদের তথ্য প্রযুক্তি ও প্রচার প্রকাশনা সম্পাদক জুয়েল বড়ুয়া, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি থুইক্যচিং মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিরূপা চাকমা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কাজলী ত্রিপুরা।

এছাড়াও সভায় উপস্থিত থেকে সংহতি জানান মঙ্গলধ্বনির শেহরীন আরাফাত, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সম্পাদক সাদিউর রহমান, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি বিপ্লব ভট্টাচার্য, সৌরভ রায়, ইমদাদ হোসেন, কাজী ইকবাল।

 সংহতি সমাবেশের সাথে একাত্মতা জানিয়ে আয়োজকদের সাথে যোগাযোগ করেছেন নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানস চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আমেনা মহসিন ও মেঘনাগুহ ঠাকুরতা।

3.Dhaka songhoti somabesh, 19.12

সমাবেশে প্রফেসর আনু মহম্মদ বলেন, পাহাড় জনগণের সম্পদ। বহিরাগত বাঙালীদের দিয়ে তা দখল করা হচ্ছে। পাহাড়ের সমস্যা হচ্ছে ভূমি সমস্যা, তা সমাধান না হলে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

 সংহতি সমাবেশের সভাপতি মাইকেল চাকমা বলেন, ‘পাহাড়িদের উপর যখন হামলা করা হয় তখন আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত বলে কোন বিভেদ থাকে না। তখন তাদের স্লোগান হয় আওয়ামীলীগ-বিএনপি-জামায়াত ভাই ভাই, এখানে কোন বিভেদ নাই। এভাবে সেখানকার সেটলাররা পাহাড়িদের উপর হামলা করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তিনি পাহাড়িদের বাঙালী হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সংসদে বাঙালী জাতিয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের জোর করে বাঙালী বানিয়েছেন। যে সংবিধান আমাদের জোর করে বাঙালী বানায় সেই সংবিধান আমরা মানি না। যে রাষ্ট্র আমাদের বাঙালী বানায় সেই রাষ্ট্র আমরা মানি না’।

জাতিয় গণ ফোরাম এর টিপু বিশ্বাস বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে যেমন সেনাবাহিনীর দাপট ছিল ঠিক এখনো পার্বত্য অঞ্চলে একই অবস্থা বিরাজ করছে, বলা যায় সেখানে সেনা শাসন চলছে। আর বর্তমানে অঘোষিতভাবে গোটাদেশে সেনা শাসন চলছে। পাহাড়িদের মূল দাবি ছিল ভুমি সমস্যার সমাধান ও আলাদা জাতি গোষ্ঠি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। সরকারের এটা প্রতিশ্রুতি ছিল। বাংলাদেশ বাঙালীদের, বাংলাদেশ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি স্বত্তার। বাংলাদেশ সবার। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসহ সকল জনগোষ্ঠিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে। তবেই এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে’।

 জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘আগে বাইশ পরিবার ছিল, এখন হয়েছে বাইশ হাজার পরিবার। এরাই এখন সর্বত্র লুটপাট ও ভূমি বেদখল করছে। ভূমিদস্যুরা পাহাড়িদের জমি কেড়ে নিয়ে দখলদারিত্ব কায়েম করছে। এ বাইশ হাজার পরিবারের সাথেই জনগণকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী থাকলে, পাহাড়িদের জমি ফেরত দেয়া না হলে সমস্যার সমাধান হবে না’।

বাসদের সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন আতিক সংহতি প্রকাশ করে বগাইছড়িতে ও কাপ্তাইয়ের উপজাতীয় তরুণীকে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। পাশাপাশি পার্বত্য চট্রগামে যে অঘোষিত সেনা শাসন চলছে তার অবসান ঘটাতে হবে এবং সেখানে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাহাড়িদের ভুমির সমস্যা সমাধান করতে হবে। যুগযুগ ধরে তারা যে জমি দখল করে আসছে তা তাদের ফেরত দিতে হবে’।

গণতান্ত্রিক গণ মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জাফর আহমেদ সংহতি প্রকাশ করে বলেন, ‘পাহাড়িরা থাকবে ঐ পাহাড়ে। বাঙালীরা কিভাবে ঐ জমি দখল করে। সেখানে কিভাবে বাঙালীরা পুনর্বাসিত হতে পারে না। সমতল ভুমিতেই বাঙালিদের পুনর্বাসিত করতে হবে। পাহাড়িদের জায়গা পাহাড়িদের ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের ভুমি ব্যবহার করতে হলে তাদের সাথে আলোচনা করে করতে হবে’।

 বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুর রহমান হামলা ও অগ্নি সংযোগের ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করে বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বাঙালির মহান বিজয় দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এ এমন এক বিজয় যে দিনে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা তা শাসক শ্রেণীর স্বাধীনতা। তা না হলে এতো বড় ঘটনার বিচার না হয়ে থাকে কিভাবে? বরং শাসকগোষ্ঠি অপরাধীদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে’।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় ইউপি সদস্য কাজলী ত্রিপুরা ঘটনার বর্ণনা দেন এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তার বক্তব্যের বেশিরভাগ অংশই ছিল সেনা বিদ্বেষী। তিনি বলেন, ‘আমি এখান থেকে ঘোষণা দিচ্ছি, পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী আর যদি এরকম করে তাহলে তারা স-সম্মানে ফিরতে পারবে না। কোন পুরুষ লাগবে না আমরা মহিলারাই যথেষ্ট। আমরা বীরের মতো লড়বো। তারা পারলে আমাদের জুম্ম জাতির মহিলাদের সাথে লাগুক।’

 তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমাদের জমি-জায়গা সেটলার ও সেনাবাহিনী দখল করে নিচ্ছে। আজ আমরা ঢাকায় এসেছি সবাইকে জানানোর জন্য যে কিভাবে আমাদের উপর বর্বরচিতভাবে হামলা করেছে। আমাদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। সেনাবাহিনী যদি পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের ভালো চোখে দেখতো তাহলে তারা সেটলার বাঙালীদের দিয়ে আমাদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালাতে পারত না। সেটলার বাঙালীরা আমাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগুন জালিয়ে দিয়েছে। আমাদের পাহাড়িদের কি অপরাধ যে আমাদের উপর এমন আচরণ করা হল। আমি একজন মহিলা ইউপি সদস্য। শুনলাম বলাবলি করছে, আনারস বাগান নাকি কাটা। আমি তখন বাড়িতেই ছিলাম। আমি দেখছি ওরা কি করছে। বাঙালীরা একের পর এক আসতে থাকল, আমাদের বাড়িতে আগুন দিল। আমার বাড়ির দুটো বাড়ির পরের বাড়িতে আগুন লাগল। আমি একজন সরকারি লোক হয়ে যদি আমার নিরাপত্তা না থাকে তাহলে, আমার ঘর পুড়ে তাহলে জনগণের নিরাপত্তা দিব কিভাবে। আমার বাড়িতে দাও দাও করে আগুন জলছে। তখন আমি বাসার বাড়িতে। দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম’।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘সেনাবাহিনী যদি পার্বত্য এলাকায় সহযোগিতা করার জন্য যায় তাহলে এমন ঘটনা বারবার ঘটে কেন? ওদের সহযোগিতা কিভাবে বারবার পাচ্ছে সেটলাররা? ঘটনার পরের দিন ১৬ ডিসেম্বর পথ অবরোধ করি। পরের দিনও করি। সেনাবাহিনী তখন টহল দিতে থাকে। আমাদের ৫০টি বাড়ি-ঘর, ৭টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হলো। বৌদ্ধ মুর্তি চুরি হয়ে যায়, চেয়ার-টেবিল ভেঙে দেওয়া হয়। একটি ক্লাব ভাঙচুর করা হয় এবং ক্লাবের সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী যেরকম লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ করেছে ঠিক আমাদেরকেও তাই করা হচ্ছে। আমি এখান থেকে ঘোষণা দিচ্ছি, পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী আর যদি এরকম করে তাহলে তারা সসম্মানে ফিরতে পারবে না। কোন পুরুষ লাগবে না আমরা মহিলারাই যথেষ্ট। বীরের মতো লড়বো আমরা। তারা পারলে আমাদের জুম্ম জাতির মহিলাদের সাথে লাগুক’।

পিসিপি’র সভাপতি থুইক্যচিং মারমা বিজয় দিবসে বগাছড়িতে হামলাকে নব্য রাজাকারদের কাজ বলে মন্তব্য করেন। যারা আনারস বাগান কেটে দেয়ার গল্প করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তিনি তাদের দালাল বেঈমান হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা হিলের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দিয়ে আন্দোলন জোরদারের লক্ষ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

উল্লেখ্য, ১৬ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় বাঙ্গালীদের করা ১৫ একর আনারস বাগানের সাড়ে ৪ লাখ ফলন্ত আনারস গাছ ও ২২ হাজার সেগুন বাগান কেটে দেওয়াকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের চৌদ্দ মাইল এলাকায় দুর্বৃত্তদের অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কয়েকটি দোকানসহ পাহাড়ীদের ১৩টি বসতঘর পুড়ে গেছে। পাহাড়ীদের দাবী ৬১ পরিবার অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নানিয়ারচরের ঘটনার পর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য জন সংহতি সমিতি সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে দাবী করেছিল, ‘নানিয়ারচরে বাঙালীদের ফলন্ত আনারস ও সেগুন বাগান কেটেছে ইউপিডিএফ;র সন্ত্রাসীরা’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন