আদিবাসী প্রসংগে কিছু কথা

ড.ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী

ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

সাম্প্রতিককালে আদিবাসী, দলিত ইত্যাদি বিভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট ছোট জনগোষ্ঠিকে সংগঠিত করার উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ‘স্বকীয়তা’র সুরক্ষার নামে নতুন করে তাদের মুখের ভাষার জন্য বর্ণমালা তৈরী বা ‘লৈখিক ভাষা’ সৃষ্টিরও প্রয়াস চলছে । এ ক্ষেত্রে কিছু বিদেশী সংস্থার উদার পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ্যণীয়। এই কর্মকান্ড এই সকল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিকে আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক-সামাজিক পরিমন্ডল থেকে পৃথক করে রাখার কোন দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রমের অংশ কি-না, তা’ অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে।

পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা ভালো কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু তা’ করতে গিয়ে দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির সাথে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া, কিংবা বৈরী অবস্থান তৈরী করা মোটেই বাঞ্চনীয় নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ইউরোপ-আমেরিকার কিছু সংস্থা এখন দেশে দেশে ‘আদিবাসী’ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইন্টারনেট সূত্রে জানা যায়, খ্রীষ্ট-ধর্ম প্রচারে অতি-উৎসাহী-কিছু চার্চ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে মাত্র ৫ হাজার জনসংখ্যার কোন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির সন্ধান পেলেই তাকে টার্গেট করে কাজ শুরু করছে।

প্রথমে চিহ্নিত জনগোষ্ঠির ধর্ম-বিশ্বাস, সামাজিক কাঠামো, ভাষা, জীবন-প্রণালী ইত্যাদি ভালোভাবে অনুসন্ধান করা হয়। তারপর তৈরী হয় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও প্রকল্প। অনেকটা ‘টেন্ডার’ আহ্বান করার মত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চার্চ সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ করে একটি চার্চ এর উপর ঐ বিশেষ জনগোষ্ঠির ’দায়িত’¡ অর্পন করা হয়। ঐ অত:পর চার্চের ব্যবস্থাপনায় সেখানে শুরু হয় ’এনজিও’ কার্যক্রম। পশ্চিমা জগতের কয়েকটি শক্তিমান রাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক-সামরিক ও কৌশলগত স্বার্থের সহযোগী তৈরীর লক্ষ্য নিয়ে এই কার্যক্রমে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে চলেছে।

শুরুতে দান-দক্ষিণা এবং সদুপদেশের মাধ্যমে সখ্যতা এবং নির্ভরশীলতা গড়ে তোলা হয়। এভাবে টার্গেট জনগোষ্ঠির কাছে তাঁরা হয়ে ওঠেন ত্রাণ-কর্তা। অত:পর চলতে থাকে চিহ্নিত জনগোষ্ঠিকে তার পারিপার্শ্বিক বৃহত্তর জনগোষ্ঠি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া। তাদেরকে বোঝানো হয় পারিপার্শ্বিক জনগোষ্ঠির শোষণ ও অবহেলার কারণেই তারা পিছিয়ে আছে। একাজে হাতের কাছে পাওয়া যায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কিছু মানুষকেও। যাঁরা নিজ নিজ এনজিও কার্যক্রমে উদার সহযোগিতার বিনিময়ে পুঁজিবাদের বিশ্ববিজয়ের এই সুদূরপ্রসারী নব-অভিযানে পথ-প্রদর্শক ও ‘লোকাল কোলাবরেটর’ এর ভূমিকা পালন করেন নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে।

কিছু রাজনৈতিক দল-উপদলকেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বিপরীতে এই সকল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে সমর্থক সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। তাঁরা কথিত ‘আদিবাসী’ সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হতে গিয়ে এমন সব কথা বলেন যা বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থের জন্য সংকট সৃষ্টি করে। পরবর্তী ধাপে শুরু হয় ধর্মান্তরকরণ। এভাবেই মিজো, নাগা, গারো, খসিয়া, বোড়ো, টিপরা সম্প্রদায় সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব ক্ষুদ্র জাতি-উপজাতি আজ খ্রীষ্ট ধর্মের বলয়ে।

আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও একই ধারায় কাজ চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ইন্টারনেটে বেশ কয়েকটি ওয়েব সাইট চালু রয়েছে বহুকাল ধরে। এগুলোতে যে ধরণের dis-information প্রচার করা হয় তা’ রীতিমত উদ্বেগজনক। এসব অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মত পাল্টা কোন ব্যবস্থা নেই। না সরকারের পক্ষ থেকে, না কোন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে।

আদিবাসী কে?
‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে-একটি অঞ্চলে সুপ্রাচীন অতীত থেকে বাস করছে এমন জনগোষ্ঠি। সেই বিচারে আজকের বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ বা আদি-বাসিন্দা কারা?

ক্ষুদ্র জাতি-উপজাতি হলেই ‘আদিবাসী’ বা আদি-বাসিন্দা হবে তেমন কোন কথা নয়। বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিম-লে ‘আদিবাসী’ বা আদি-বাসিন্দাদের উত্তরসূরী হবার প্রথম দাবীদার এদেশের কৃষক সম্প্রদায়, যারা বংশ পরম্পরায় শতাব্দির পর শতাব্দি মাটি কামড়ে পড়ে আছে। বান-ভাসি, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, নদী-ভাঙ্গন, ভিনদেশী হামলা–কোন কিছুই তাদেরকে জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। নদীভাঙ্গনে কেবল এখান থেকে ওখানে, নদীর এক তীর থেকে অপর তীরে সরে গেছে। এ মাটিতেই মিশে আছে তাদের শত পুরুষের রক্ত, কয়েক হাজার বছরের। কাজেই বাংলার ‘আদিবাসী’ অভিধার প্রকৃত দাবীদার বাংলার কৃষক — আদিতে প্রকৃতি পুজারী, পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন।

গংগা-ব্রক্ষ্মপুত্র-মেঘনার এই বদ্বীপভূমিতে আদি-অষ্ট্রিক, অষ্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মোংগল, টিবেটো-বার্মান—বিচিত্র রক্তের সংমিশ্রন ঘটেছে খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতকের পূর্বে। অত:পর ধাপে ধাপে এসেছে ‘শক-হুনদল পাঠান-মোগল’, সেই সাথে ইরানী-তুরানী-আরব। সবশেষে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আমলে স্বল্পমাত্রায় হলেও পর্তুগীজ, আর্মেনিয়ান, ইংরেজ, ফরাসী, গ্রীক। কালের প্রবাহে বিচিত্র রক্তধারা একাকার হয়ে উদ্ভূত এক অতি-শংকর মানবপ্রজাতি-‘বাঙালী’।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ও খন্ড জাতি-উপজাতি আজকের দিনেও তাদের পৃথক সত্ত্বা নিয়ে বিরাজ করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মাঝখানে বা প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও তাদের অবস্থান বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। এর কারণ প্রথমত: আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে জাতিসত্ত্বার বিকাশে অপূর্ণতা এবং যথার্থ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সমাজচেতনার অনুপস্থিতি। দ্বিতীয়ত: অসম ও শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সমাজের দূর্বলতর অংশের দারিদ্রের চক্রজালে আবদ্ধ থাকা এবং তৃতীয়ত: বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মধ্যে সমাজের ক্ষুদ্রতর বা পিছিয়ে থাকা অংশের প্রতি মানবতাবোধে উজ্জীবিত ‘গ্রহনীয়’ বা রহপষঁংরাব দৃষ্টিভংগির অভাব। আমাদের সমাজে অন্য ধর্মালম্বী বা অন্য জাতি-গোষ্ঠীর কোন মানুষকে হাত বাড়িয়ে বরণ করে নেয়ার মানসিকতার অভাব খুবই স্পষ্ট। ফলে সুদীর্ঘকার পাশাপাশি বা কাছাকাছি থেকেও এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিজ নিজ বৃত্তে আবদ্ধ থেকে গেছে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার এতদঞ্চলে আগমন কয়েকশ’ বছরের বেশী পূর্বে নয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এই তিন প্রধান সম্প্রদায়ের এতদঞ্চলে আগমনের নানা বিবরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে ইতিহাসে বিধৃত আছে।

চাকমাদের এতদঞ্চলে আগমন তিন- চারশ’ বছর পূর্বে। থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারের কোন একটি অঞ্চলে গোত্রীয় সংঘাতের জের ধরে এই জনগোষ্ঠি আরাকান হয়ে কক্সবাজার এলাকা হয়ে চট্টগ্রামে আগমন করে এবং চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপন করে বাস করতে থাকে। এক সময়ে তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাজশক্তিতেও পরিণত হয়েছিল। এই জনগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয় ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশরা লুসাই পাহাড়ে তাদের দখল স্থাপনের জন্য হামলা চালাবার সময় চাকমা সম্প্রদায়কে কাজে লাগায়। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে মিজোদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করে। তার বিনিময়ে লড়াই শেষে তাদেরকে রাঙামাটি অঞ্চলে বসতি গড়ার সুযোগ দেয়া হয়।
মারমা সম্প্রদায়ের ইতিহাসও প্রায় একই রকম। কয়েক বছর আগে বান্দরবনের সাবেক মং রাজা অংশে প্রু চৌধুরী এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন-‘আমরা এই অঞ্চলে আদিবাসী নই’। বান্দরবন এলাকায় মারমা বসতি ২০০ বছরেরও পুরনো। মং রাজাদের বংশলতিকা এবং ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকায় এ বিষয়ে সংশয়ের কিছু নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩য় বৃহৎ জনগোষ্ঠি ‘ত্রিপুরা’। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। কথিত আছে সেখানকার রাজরোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির একটি ক্ষুদ্রতর অংশ স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়ে এখানে এসেছে। সেটাও বেশী দিনের কথা নয়। এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে আরো ৮টি ক্ষুদ্র জাতি। তাদের কোন কোনটি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদেরও পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে। সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাদের পৃথক নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বা দৃশ্যমান । বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, মনিপুরী, খসিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের অধিকাংশেরই বৃহত্তর অংশ রয়েছে প্রতিবেশী ভারতে। ক্ষুদ্রতর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে আগে-পরে বাংলাদেশে এসেছে। তারাও দীর্ঘকাল ধরে এদেশে বসবাস করছে বিধায় এদেশের নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার ও সমসুযোগ তাদের অবশ্যপ্রাপ্য। তবে এদের কোনটিই বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা বা ’আদিবাসী’ নয়।

এই সকল জনগোষ্ঠির প্রধান দাবী তাদের পৃথক জাতিস্বত্ত্বার স্বীকৃতি । সরকার এসব জনগোষ্ঠিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের আকাংখা অনুযায়ী পৃথক জাতি-সত্ত্বার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানেও কোন আপত্তি থাকা উচিত নয়। কারণ সামগ্রিক জাতীয় পরিচয়ে তাতে কোন সমস্যা দেখা দেয় না।

একটি আধুনিক জাতির-রাষ্ট্র যতই এগিয়ে যাবে তার পরিমন্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠি কাল-প্রবাহে বৃহত্তর দৈশিক আবহে ততই একক ও অভিন্ন পরিচয়ে ধাতস্থ হয়ে যাবে। এটাই ইতিহাসের ধারা। দুনিয়া জুড়ে প্রতিটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা বিরাজমান। এক হিসাবে পৃথিবীতে এখনও এরকম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৫০০০। এদের প্রত্যেকের পৃথক সত্ত্বার স্বীকৃতি মেনে নিয়েই তাদেরকে আত্মস্থ করে নিতে উদ্যোগী হতে হবে সব জাতি-রাষ্ট্রকে। সেজন্যে প্রয়োজন উদার ও সংবেদনশীল মানসিকতা। পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠির প্রতি সহমর্মিতা। তাদেরকে পিছিয়ে থাকা অবস্থান থেকে অতিদ্রুত সামগ্রিক জাতীয় পরিমন্ডলে অন্যদের সমকক্ষতায় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ-স্বীকারের মানসিকতা।

পশ্চিমা বিশ্ব এখানেই বাধ সাধছে:
পশ্চিমা বিশ্ব এখানেই বাধ সাধছে। একদিকে সারা দুনিয়াজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘নোডাল পয়েন্ট’ গুলিতে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে চলছে বিভিন্ন দেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিগুলোকে পশ্চিমা জগতের ‘আউটপোষ্টে’ পরিণত করা এবং সংশ্লিষ্ট জাতি-রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি থেকে তাদেরকে পৃথক করে দুনিয়া জুড়ে পশ্চিমের কায়েমী স্বার্থের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
‘আদিবাসী’ শ্লোাগানটি এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী: রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক। ই-মেইল[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন