‘আদিবাসী নারীরা জাতিগত নিপীড়নের শিকার’- আদিবাসী নারী সম্মেলনে বক্তারা

পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারীদের প্রতি পাক বাহিনীর মতো নির্যাতন নিপীড়ণ চালানো হচ্ছে- সন্তু লারমা

1

স্টাফ রিপোর্টার:

‘আদিবাসী নারীরা দুইভাবে নির্যাতিত। একটি হচ্ছে তারা জাতিগত নিপীড়নের শিকার ও দ্বিতীয়ত নারী হিসেবে তারা অন্য নারীদের তুলনায় বেশী নির্যাতিত। বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের যেমন লড়াই করে অধিকার আদায় করতে হয় তেমনি নিজেদের সমাজেও যেসব প্রতিবন্ধিকতা ও বৈষম্যগুলো আছে সেগুলোর বিরুদ্ধেও লড়াই করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়’।

‘আদিবাসী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসুন’ শ্লোগানকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকার আসাদগেট সংলগ্ন সিবিসিবি মিলনায়তনে দু’দিনব্যাপী ‘তৃতীয় জাতীয় আদিবাসী নারী সম্মেলনে’ বক্তারা এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও কাপেং ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর আর্থিক সহযোগিতায় এ সম্মেলন শুরু হয়েছে।

শনিবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম উদ্বোধনী অধিবেশনের অতিথিবৃন্দদের নিয়ে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু ম্রং এর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।

বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফের স্ত্রী য়েন য়েন, তপতী সাহা, প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর, ইকনমিক সিকিউরিটি এন্ড রাইটস, ইউএন ওমেন; ওয়াসিউর রহমান তন্ময়, প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন; বাসন্তী মুর্মু, সভাপতি, আদিবাসী নারী পরিষদ ও যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চৈতালী ত্রিপুরা, যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও ভাইস চেয়ারপার্সন, কাপেং ফাউন্ডেশন। সঞ্চালনা করেন নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র এদেশের আদিবাসীদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে এ দেশ যে বহুজাতিগোষ্ঠীর দেশ সেটি অস্বীকার ও আদিবাসীদের আত্মপরিচয়কে নসাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও রাষ্ট্র এখনো নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি’।

তিনি বলেন, ‘আদিবাসী নারীসহ সকল নারীকে একাত্ম হয়ে তাদের অধিকার আন্দোলনকে আরো জোরদার গড়ে তুলতে হবে’। পুরুষদেরও নারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোসহ নারী অধিকার আন্দোলনে সামিল হওয়ারও আহ্বান জানান।

তিনি আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্যেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের নারী সমাজের প্রতি পাকবাহিনী যে অত্যাচার নিপীড়ণ চালিয়েছে তা আজকের স্বাধীন দেশেও পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারীদের প্রতি ঠিক সেই ধরনের নির্যাতন নিপীড়ণ চালানো হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। নারী অধিকার বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও নারী অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবাসহ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন করতে হবে বলে তিনি বলেন।

তিনি আরো বলেন, নারী মুক্তি আন্দোলন হচ্ছে রাজনৈতিক আন্দোলন। তাই আদিবাসী নারীদের রাজনৈতিক আন্দোলনে সামিল হতে হবে। নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশে বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু কেবল বিষয় ভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারী মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনকে যথাযথভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। সেজন্য বিষয় ভিত্তিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনে জোরালোভাবে নারীদের সামিল হতে হবে’ বলে তিনি অভিমত তুলে ধরেন।

সম্মেলনের উদ্বোধক আয়েশা খানম বলেন, ‘বাংলাদেশের নারী আন্দোলন এবং নারী অধিকার কখনই পূর্ণতা পাবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত আদিবাসী নারীদের সম্পৃক্ততা থাকবেনা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে ন ‘। তিনি ‘বাজেটে আদিবাসী নারীদের জন্য পৃথক বরাদ্দ’ রাখারও প্রস্তাব জানান।

তিনি আরো বলেন, ‘আদিবাসী নারীদেরকে যেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে যুদ্ধ করতে হয় তেমনি নিজেদের সমাজেও যুদ্ধ করতে হয়ে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আদিবাসী নারীদের অধিকার আন্দোলনের সাথে সবসময় আছে এবং থাকবে। আদিবাসী নারী, বাঙ্গালি নারী সেতুবন্ধন রচনা করে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে বেগবান করার আহ্বান জানিয়ে তিনি সকল নারীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার’ আহ্বান জানান।

চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের স্ত্রী য়েন য়েন বলেন, ‘আদিবাসী নারীরা দুইভাবে নির্যাতিত। একটি হচ্ছে তারা জাতিগত নিপীড়ণের শিকার ও দ্বিতীয়ত নারী হিসেবে তারা অন্য নারীদের তুলনায় বেশী নির্যাতিত। বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের যেমন লড়াই করে অধিকার আদায় করতে হয় তেমনি নিজেদের সমাজেও যেসব প্রতিবন্ধিকতা ও বৈষম্যগুলো আছে সেগুলোর বিরুদ্ধেও লড়াই করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তবে আশার কথা হলো আগে যেভাবে প্রথাগত ব্যবস্থায় কারবারী বা হেডম্যান হিসেবে দিনদিন আদিবাসী নারীদের সংখ্যা বাড়ছে’।

তপতী সাহা বলেন, ‘জাতিসংঘ নারীদের জন্য বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের অধিাকরের জন্য সর্বদা সচেষ্ট’। তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পাশে গিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

উদ্বোধনী অধিবেশনের পর ‘বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের’ গত দুই বছরের কার্যক্রম তুলে ধরেন নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, উপকূল এবং ঢাকা অঞ্চলের প্রতিনিধিরা তাদের স্ব স্ব অঞ্চলের নারীদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন।

দুই দিনব্যাপি এই সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে আরো যোগ দিবেন, চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা, কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সোমা দে, আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং প্রমুখ।

সম্মেলনে পাহাড়, সমতল এবং ঢাকায় অবস্থানরত চাকমা, সাঁওতাল, মারমা, ত্রিপুরা, উরাও, রাখাইন, গারো, হাজং, খাসি, পাহাড়িয়া, রবিদাস, বম, তঞ্চঙ্গ্যা, মাহাতো, বর্মন, খিয়াং, মুন্ডা, চাকসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রয়ায় দুইশতাধিক নারী যোগ দেন। আগামীকাল রবিবার ‘আদিবাসী নারীদের অধিকারের ঘোষণাপত্র’ পাঠের মধ্য দিয়ে দু’নিব্যাপী এই সম্মেলনের সমাপ্তি হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন