আট লাখ রোহিঙ্গার ভারে কাতারাচ্ছে বাংলাদেশ

 

 

উখিয়া প্রতিনিধি:

২৫ আগস্টের পর থেকে আজ রবিবার (১০ আগস্ট) পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী, উগ্র বৌদ্ধ ও সন্ত্রাসীদের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তত তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

আগে থেকে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সব মিলিয়ে আট লাখ রোহিঙ্গার ভারে এখন কাবু বাংলাদেশ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, না যাচ্ছে ঠেকানো, না যাচ্ছে ফেরানো।

উখিয়ার বালুখালী ঢালায় নতুন অস্থায়ী রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, মো. কাছিম ও মজুমা বেগমের আদরের কন্যা সন্তান সামছিকে। ১১ বছরের এ শিশু নিজ ঘরে মা বাবা, পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে খেলাধুলায় মত্ত থাকার কথা। কিন্তু তাকে ভিনদেশ বা বাংলাদেশের পাহাড়ে জঙ্গলে খোলা আকাশের নিচে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। গত ১১দিন আগে মিয়ানমারের রাখাইনের মংডুর দক্ষিণ শিলখালী নিজ পাড়ায় সেনা ও উগ্রবৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তার বাবা মাকে। তার ৫বছরের ছোট ভাই এখন কোথায় সে জানে না।

শনিবার সকাল ১১টার দিকে উখিয়া টিভি রিলে কেন্দ্রের সামনে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি রাবার বাগানে অস্থায়ী পলিথিনের তাঁবুতে বসে থাকতে দেখা গেছে প্রতিবেশী আশ্রয়দাতা হামিদা খাতুনের (৩০) দুই শিশুর সাথে। হামিদা খাতুনও একই গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামী আজিজুর রহমানকে মিয়ানমার সেনা ও বৌদ্ধরা হামলা চালিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে।

আর একটু দূরে রাবার বাগানে গাছের নিচে দেখা হলো হুমরা নামের ১০ বছরের এক শিশুর সাথে। সে জানালো মংডুর উদং গ্রাম থেকে তারা গত মঙ্গলবার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কথা বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে গেয়ে জানালো তাদের পাড়ায় সেনাবাহিনী গুলি করে তার পিতা ছৈয়দুল্লাহকে হত্যা করে।

সেনাবাহিনীর সাথে থাকা বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা তার মা জনু বেগমকে ঘর থেকে বের করে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সে জানালো তার ১১ বছরের ভাই নজিবুল্লাহকেসহ চাচা আবুল কাশেম তাদেরকে সাথে নিয়ে এসেছে। ভাই বোন দুই এতিম শিশু এক সাথে হয়ে মা বাবার স্মৃতি ও আদরের কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। চাচা আবুল কাশেম জানালো মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রবৌদ্ধরা তার ভাই ও ভাবিকে গুলি করে, কুপিয়ে হত্যা করে। উপায়ান্তর না দেখে পাড়ার অন্যান্যদের সাথে গত তিন দিন আগে জান বাঁচাতে নিজ স্ত্রী তিন ছেলে মেয়ে ও নিহত ভাইয়ের দুই অনাথ শিশুকে নিয়ে বাংলাদেশে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে।

তবে সাথে তেমন কিছু আনতে না পারায় কোন রকমে এক মুটো খাবার ছেলেগুলোর মুখে তুলে দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে আবুল কাশেমকে।

রাখাইনের বুচিডং এলাকার লংডং গ্রাম থেকে উখিয়ার বালুখালী ঢালায় নতুন অস্থায়ী ভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে গতকাল শনিবার এসে রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়েছে আনোয়ারা বেগম (৩০), সাথে তিনটি ছোট ছেলে মেয়ে। দেশ, গ্রাম, মাতৃভূমি ও জীবনের অধাঙ্গ প্রিয় স্বামী ছৈয়দ হোছনকে পিছনে ফেলে আসতে হয়েছে। ৯দিন পূর্বে গ্রাম ছেড়ে আসার সময় নিজের চোখের সামনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পালিয়ে আসার পথে তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে জানালেন আনোয়ারা। এসব স্মৃতির চেয়ে এখন আনোয়ারার সামনে প্রধান ভাবনা কিভাবে কোথায় আশ্রয় পাবে ও ছোট ছোট তিন শিশুকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে।

এধরনের অনেক স্বামী, ভাই, মা, বাবা, বোনসহ নিকটজন হারানো পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘশ্বাসে এলাকার পরিবেশও কেমন যেন হয়ে উঠছে।

এধরনের পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। গত প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে চরম খাদ্য, চিকিৎসা, পানীয় জল ও স্যানিটেশনের মারাত্বক সংকটে ভোগতে হচ্ছে এদের।

পূর্ব থেকে উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান নেওয়া শরনার্থীদের সেবায় নিয়োজিত জাতি সংঘের শরনার্থী সংস্থা, শিশু তহবিল, অভিবাসন সংস্থা সহ অসংখ্য এনজিও–আইএনজিও এর কার্যক্রম থাকলেও নতুন আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এসব গুরুতর সমস্যা মোকাবেলায় তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

ফলে এসব সংকটের কবলে পড়া রোহিঙ্গাদের মাঝে ব্যাপক আকারে মানবিক সংকট দেখা দেওয়ার আশংকা রয়েছে। বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে ব্লক নেতা আবুল হোসেন বলেন, গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে আমরা এখানে আশ্রয় নিলেও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় পরিবার পিছু মাত্র ২৫ কেজি চাল ছাড়া আর কোন সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আমরা চরম সংকটে রয়েছি।

এছাড়া সম্প্রতি প্রায় তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও বাংলাদেশী নাগরিকদের দয়া ও সহযোগিতা ছাড়া আর কোন সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। রাখাইনের চলমান সহিংস ঘটনায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠি উদ্বেগ প্রকাশ করলেও নতুন আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি সহযোগিতার হার তেমন বাড়াতে দেখা যাচ্ছে না বলে স্থানীয় সচেতন লোকজনের অভিযোগ।

মিয়ানমার সংক্রান্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংগি লি রাখাইনের চরম মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন ইতিমধ্যে এক হাজারের বেশী রোহিঙ্গাকে সামরিক বাহিনী ও উগ্রবৌদ্ধরা হত্যা করেছে। তবে এটি উভয় পক্ষে হতে পারে কিন্তু বেশীর ভাগ রোহিঙ্গা বলে তিনি মন্তব্য করেন।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগষ্টের পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রবৌদ্ধ, অমুসলিমদের অত্যচার নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তত তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।

তবে উখিয়া সদর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৯ কি. মিটার এলাকা জুড়ে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম জলপাই তলী, তুমব্রু পশ্চিম কুল, তুমব্রু কোনারপাড়া, বাইশপাড়ি সহ বিভিন্ন এলাকায় আরো প্রাায় ৫০ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অস্থায়ী ভাবে আশ্রয় নিয়েছে। যেগুলোর স্রোত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বলে স্থানীয় লোকজন দাবি করছে।

এছাড়াও সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে গতকালও ব্যাপক হারে পায়ে হেঁটে, বিভিন্ন যানবাহন করে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের লোকজনের দাবি যে হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে। তবে সবমহলে এখন প্রশ্ন অধিক জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের পক্ষে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভার আদৌ বইবার ক্ষমতা আছে কি না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন