অ্যামনেস্টির নতুন প্রমাণ : রাখাইনে রোহিঙ্গাদের না খাইয়ে মারা হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ধ্বংসাত্মক তৎপরতা, নির্যাতন চলছেই। এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে এখন অনাহারে মারছে তারা। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সহিংসতা নিয়ে নতুন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে গত বুধবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এসব কথা বলেছে।

গত জানুয়ারির শেষ দিকে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি বাংলাদেশে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। রাখাইনে সেনাবাহিনীর চাপিয়ে দেওয়া ক্ষুধা এবং অব্যাহত অপহরণ ও লুটতরাজের মুখে কীভাবে তাঁরা পালাতে বাধ্য হয়েছেন, সাক্ষাৎকারে সে কথাই তুলে ধরেন তাঁরা। অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাও গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসজুড়ে রাখাইন থেকে পালানো হাজারো রোহিঙ্গার বিষয়ে তথ্য নথিভুক্ত করেছে। সীমান্ত পেরিয়ে এখনো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ অব্যাহত আছে।

অ্যামনেস্টি বলেছে, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের সম্পদ লুট করছে; তাদের অপহরণ করছে; নারী-পুরুষ-শিশুকে অনাহারে থাকতে বাধ্য করছে। এসব কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য, এই গোষ্ঠীর জন্য এমন একটি অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করা; যাতে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

মানবাধিকার সংস্থাটির অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’ অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী। এ রকম অভিযানের মুখেই গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন তল্লাশিচৌকিতে রোহিঙ্গাদের অর্থকড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্র লুটে নিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গা বাড়িঘরে গিয়ে তাদের নারী ও তরুণীদের অপহরণও করছে। ফলে দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠছে তারা। রোহিঙ্গারা বলছে, বহুমুখী নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে প্রধানত খাদ্যাভাবের কারণেই তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।

রাখাইনের বুথিডং এলাকার কাছাকাছি একটি গ্রামের বাসিন্দা দিলদার বেগম (৩০) বলছিলেন সে কথাই, ‘আমরা খাবার পাচ্ছি না, তাই পালিয়ে যাচ্ছি।’ অ্যামনেস্টি বলেছে, এ খাদ্যসংকট সৃষ্টির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড। তারা রোহিঙ্গাদের নিজেদের খেতখামারে যেতে দিচ্ছে না। যেতে দিচ্ছে না বাজারঘাটে। মানবিক ত্রাণ গ্রহণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করছে।

সংস্থাটি বলেছে, যেসব রোহিঙ্গা গ্রাম ছাড়তে চাচ্ছে না, কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতার ফলে তাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আগের মতো হত্যা, ধর্ষণ ও গ্রামগুলো ব্যাপকভাবে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে নিরাপত্তা বাহিনী এখন রোহিঙ্গা নির্মূলে নীরব এবং আরও সূক্ষ্ম ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এমন সব প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, যাতে এ ইঙ্গিত মেলে, গত আগস্টের শেষ ভাগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শত শত রোহিঙ্গাকে হত্যা করে লাশ গণকবরে চাপা দিয়েছে।

মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি সাংবাদিকদের বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড ও লাশ নষ্ট করে ফেলার ঘটনা ‘গণহত্যা সংঘটনেরই ছাপ’।

এর আগে জানুয়ারিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, তারা ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। গত বছরের শেষ নাগাদ যে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়, তাতে তাদেরই লাশ ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত-বঞ্চিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ত্রুটি বা অসদাচরণের অভিযোগ কয়েক মাস ধরেই বারবার নাকচ করার পর ওই স্বীকারোক্তি দেয় তারা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন