অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য অঞ্চল শক্তি বাড়াচ্ছে আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলো

অস্থির পাহাড়ে দিশেহারা মানুষ- ১

বাঘাইছড়ি1

সালেহ আকন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে

পাহাড়ে শান্তি নেই। উল্টো দিন দিন আরো অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য অঞ্চল। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা দিন দিন তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। মজুদ বাড়াচ্ছে অস্ত্র গোলাবারুদের। সীমান্ত হয়ে ঢুকছে এসব অস্ত্র। আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস ও ইউপিডিএফের সশস্ত্র উইংগুলোই এখন অশান্ত করে রেখেছে পুরো পাহাড়ি অঞ্চল। বাঙালিই শুধু নয়, তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না পাহাড়ি উপজাতিরাও।

অশান্ত পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’। সশস্ত্র সংগঠন জনসংহতি সমিতি-জেএসএসের (সন্তু লারমা) সাথে করা এ চুক্তি এরই মধ্যে পার করেছে সাড়ে ১৮ বছর। সরকারের পক্ষ থেকে পূরণ করা হয়েছে চুক্তির বেশির ভাগ শর্ত। কিন্তু পাহাড়ে হানাহানি বন্ধে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল তা বন্ধ করেনি এই অঞ্চলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি এখনো বন্ধ হয়নি।

স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সাথে তারা জড়িত নয়। এসব সংগঠনের প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীদের ভয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মুখ খুলতে ভয় পান।



সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এই এলাকায় চাকরি করেন, তারা শুধু দিন গণনা করেন কবে এ এলাকা থেকে অন্যত্র বদলি হবেন। কোনো কোনো থানার ওসিও ভয়ে ওই সন্ত্রাসীদের তৎপরতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও সেখানে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়।

বান্দরবান যুবলীগের আহবায়ক কিউচিং মারমা বলেন, সন্ত্রাসীদের কাছে তারা অসহায়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেই তাকে ক্ষতির শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য বাবু মংপু মারমা গত ১৩ জুন অপহৃত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। যুবলীগের ওই নেতা বলেন, জেএসএসের সন্ত্রাসীরা তাকে তিনবার অপহরণ করেছে। বিভিন্নভাবে তিনি ছাড়া পেয়েছেন।

ততততত

বান্দরবানের রাজভিলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কেশৈ অং মারমা বলেন, আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। শান্তি চাই। কিন্তু সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা লোকজন অপহরণ করছে। কাউকে কাউকে তারা অপহরণের হুমকি দিচ্ছে।

বান্দরবান উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক ও কুহালাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সানুপ্রু মারমা বলেন, তারা শান্তিতে থাকতে চান। কিন্তু সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ। উপজাতীয় সম্প্রদায়ের নেতা মেসাসিং মারমা এবং এমি প্রু মারমাসহ অনেকেই বলেছেন, তারা শান্তিতে বসবাস করতে চান। কিন্তু সন্ত্রাসীদের কারণে তারা অতিষ্ঠ।

পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, প্রত্যেকটি সেক্টর থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদেরকে চাঁদা দিতে হয়। শুধু বাঙালিরাই নয়, পাহাড়িরাও সন্ত্রাসীদেরকে চাঁদা দেয়। চিনু বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি, আমাদেরকে চাঁদাবাজ ও অস্ত্রবাজদের হাত থেকে বাঁচান।

সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউপি নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, পাহাড়ে আমরা অস্ত্রের কাছে হেরে গেছি। পুলিশও সারাক্ষণ অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ থাকে। ভোটকেন্দ্রগুলো অস্ত্রবাজরা দখল করে নিয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতেও পর্যাপ্ত ফোর্স ছিল না। তাদের কাছে এমন কোনো ভারী অস্ত্র নেই যা না আছে। এসব সন্ত্রাসী একমাত্র সেনাবাহিনীকে ভয় পায়। তিনি বলেন, এ সন্ত্রাসীদের পক্ষেই কিছু মানুষ ভাড়ায় খাটছে।

Bandarban-Arms-pic-3

একের পর এক ঘটনা ঘটলেও পাহাড়ি থানাগুলোতে মামলার সংখ্যা সামান্য। স্থানীয় সূত্র জানায়, এখানে চাঁদাবাজি হয়, খুন হয়, ধর্ষণ হয়, অপহরণ হয়, গুম হয়-কিন্তু মানুষ মামলা দায়ের করে না।

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার মনসুর আলী বলেন, গত ১৩ জুন তার স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে স্থানীয় ঘিলা তঞ্চঙ্গার ছেলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পিসিপির সদস্য কাজল তঞ্চঙ্গা। ওই গৃহবধূ জানান, কাজল তার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে তার কাপড় খোলার চেষ্টা করে। ধর্ষণে ব্যর্থ হলে তার গলার স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে কেটে পড়ে সে। রোয়াংছড়ি থানার ৩০০ গজের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে।

এ ব্যাপারে সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান চহা মং মারমাকে বিচার দেয়া হলে তিনি কাজলকে কয়েকটি চড় থাপ্পড় মেরে বিচার শেষ করে দেন। ওই গৃহবধূ বলেন, থানায় মামলা করবেন তারও সাহস পাচ্ছেন না। মামলা করলে ওরা মেরেই ফেলবে।

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মো: মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, ঘটনা কিছু ঘটে ঠিকই, কিন্তু মামলা হয় না। বাদি কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, এই থানায় চলতি বছর ছয় মাসে মামলা হয়েছে মাত্র তিনটি। এর আগে ২০১৫ সালে এই থানায় মামলা হয় ছয়টি, ২০১৫ সালে মামলা হয় মাত্র দু’টি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পার্বত্য এলাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ঘটনায় থানায় কেউ মামলা দায়ের করেন না। নিজের এবং পরিবার পরিজনের জীবননাশের ভয়ে অনেকেই মামলা দায়ের করেন না।

বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অংচাখই কার্বারী, উপজেলা আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি শাকুয়াই মারমা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রহর কান্তি চাকমা বলেন, পার্বত্য এলাকায় চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, জেএসএস এবং ইউপিডিএফ এই চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। তবে বিলাইছড়ির কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, এই এলাকায় ২০০৭ এর পর ইউপিডিএফ নেই। এই এলাকা জেএসএস নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে চারটি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটিতেই জয়ী হয় জেএসএস। তারা বলেন, তাদের হাতে অস্ত্র আছে। তাদের কথা মানতেই হবে। অন্যথায় তারা নানাভাবে ক্ষতি করবে। অংচাখই কার্বারী বলেন, ‘আমরা তো দাদা জঙ্গলে বাস করি। আমাদের জঙ্গলে যেতে হয়। পুলিশ তো সারাক্ষণ সাথে থাকবে না।’

দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান)। পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও গাছপালা বেষ্টিত মনোরম দৃশ্যের এ ভূমিতে রয়েছে বাঙালি ও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য তা আজ ভূলুন্ঠিত বলে অনেকেই আক্ষেপ করেন।

১৫ এপ্রিল বান্দরবানের লামায় উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন তিন বাঙালি গরু ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় তিন সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়। ১৩ জুন অস্ত্রের মুখে অপহরণ হয় বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য মংপু মারমা। এ ঘটনায় জেএসএসের ৩৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পরিবার।

৩০ মে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে জেএসএস কর্মীরা মুকুল কান্তি চাকমা নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সার্জেন্টকে ডেকে নেয়ার পর আজো তার খোঁজ মেলেনি। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির সাজেকে এক সেনাকর্মকর্তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার গাড়িতে আগুন দেয় উপজাতি সন্ত্রাসীরা।

২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় পাঁচ জেএসএস (সংস্কার) সন্ত্রাসী। উদ্ধার হয় বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র। একই বছরের ২৬ জুলাই রাঙ্গামাটিতে জেএসএস-ইউপিডিএফ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তিনজন এবং ২৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে জেএসএস-ইউপিডিএফের আরেকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল দেশী-বিদেশী ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। শান্তিচুক্তির সময় শান্তিবাহিনীর অস্ত্রের আত্মসমর্পণ যেমন প্রমাণ করেছিল তাদের কাছে আধুনিক অস্ত্রের কোনো অভাব ছিল না।

ঠিক সম্প্রতি এসব ঘটনা পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতিকে নতুন করে স্পষ্ট করে। এ ছাড়া জেএসএস প্রধান সন্তু লারমার শান্তি চুক্তি ‘পূর্ণ’ বাস্তবায়নের অযৌক্তিক দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। এসব কথা বললেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, এই এলাকার মানুষ চরম ভয়ের মধ্যে আছে।

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি থানার ওসি মো: মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের খবর আসে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে অতি গোপনেও মুখ খুলতে চায় না কেউ।

গত ২৩ জুন বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে সমবেত হয়েছিলেন ভুক্তভোগী পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের শত শত সাধারণ মানুষ। সমাবেশে বক্তারা জেএসএস ও ইউপিডিএফের অব্যাহত চাঁদাবাজি, খুন, গুম, অপহরণের প্রতিবাদ জানান।

উপজাতি কোটার পুরোটাই একাকী চাকমারাই ভোগ করছে বলে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সব নৃগোষ্ঠীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তারা। এ ছাড়া বান্দরবানের পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া ঐতিহাসিক স্বর্ণমন্দির ফের খুলে দেয়ার দাবি জানান।

এর আগের দিন রাঙ্গামাটি রিজার্ভ বাজার এলাকায় এক সমাবেশের আয়োজন করে স্থানীয় বাঙালিরা। এক চাকমা কিশোরীকে ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করে তারা ওই সমাবেশ করে।

– সূত্র: নয়া দিগন্ত

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন