অভ্যন্তরীণ সংঘাত আড়াল করছে রাখাইন সংকট

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

সরকারে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে লড়াইকে আড়ালে রাখছে রাখাইনে সহিসংতা নিরসনের প্রচেষ্টা। প্রকাশ্যে তারা একতার একটি ভদ্র আচরণ বজায় রাখলেও সরকার পরিচালনা নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান মিং অং হিলাইং ও বেসামরিক নেতা অং সাং সু চি’র মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। রাখাইনের ঘটনাবলীর ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সেনাবাহিনী সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পক্ষে। কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে সেখানে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমার লেডি সেনাবাহিনীর ওই ইচ্ছা প্রতিহত করে আসছেন।

পর্দার আড়ালে এই বিষয়টি এখনো সরকারি এজেন্ডায় প্রভাব বিস্তার করে আছে। এ কারণে সু চি তার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সফর বাতিল করেন। ঠিক ওই সময় প্রেসিডেন্ট হিতিন কিয়াউ-এর চিকিৎসা চলছিলো। ফলে সু চি দেশ ছাড়লে সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা প্রথম ভাইস-প্রেসিডেন্ট মিন্ত সোয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন। আর তখন তিনি যে সেনাবাহিনীর ইচ্ছা অনুযায়ী জরুরি অবস্থা অনুমোদন করতেন তা একরকম নিশ্চিত ছিলো। এমনটি যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে রাজধানী নেপিদো’র নিজের অফিসেই থেকে যান মিয়ানমার লেডি।

কিন্তু এটা সংঘাতের মাত্র একটি দিক। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রীর আরো আশংকা, পর্দার আড়ালে সিনিয়র জেনারেল মিয় অং হিলাইং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ২০১৬ সালে অং সাং সু চি যখন সরকার গঠন করেন তখনই তিনি সেনাপ্রধানের মেয়াদ আর মাত্র দু’বছরের জন্য বাড়াতে রাজি হয়েছিলেন বলে সরকারের ভেতরের সূত্র থেকে জানায়। কিন্তু মিন অং হিলাইং ও সেনাবাহিনী চেয়েছিলো ওই মেয়াদ যেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কাছাকাছি সময় ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত, পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়।

এই প্রকাশ্য বিরোধগুলো নিস্পত্তির একটিই মাত্র জায়গা – ন্যাশনাল ডিফেন্স এন্ড সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনডিএসসি)। এই কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়টিও সু চি এড়িয়ে চলছেন। যদিও এই কাউন্সিলের প্রধান প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালে নতুন সরকার গঠনের পর থেকে একবারও এই কাউন্সিলের বৈঠক বসেনি। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের জন্য কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য চাপ দিচ্ছেন সেনাপ্রধান।

সরকারের সূত্রগুলো জানায়, জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা শুধু এনডিএসসি’র। রাখাইন নিয়ে এ পর্যন্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় – গত অক্টোবরের শেষে রাখাইনে ‘সন্ত্রাসী হামলা’র পরপরই একটি এবং অতি সম্প্রতি আরেকটি। তবুও এনডিএসসি’র বৈঠক হয়নি। সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান থান শোয়ে সম্প্রতি পরামর্শ দিয়ে বলেন যে রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য এনডিএসসি’র বৈঠক ডাকার সময় হয়েছে। কিন্তু সু চি এসব আহ্বানে সাড়া দেবেন বলে মনে হয় না। এর কারণ মূলত সেখানে আলোচনার বিষয়বস্তুর উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, থাকবে সেনাবাহিনীর।

এনডিএসসি’র সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট ও দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট – এদের একজন সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা, সেনা প্রধান ও উপ সেনাপ্রধান, পার্লামেন্টের নিম্ন ও উচ্চ কক্ষের দুই স্পিকার, সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা তিন মন্ত্রী – প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী – অং সাং সু চি। কাউন্সিলের কার্যক্রম সম্পর্কে ভালো খবর রাখেন এমন ব্যক্তিরা যদিও বলছেন যে কোন সিদ্ধান্ত সাধারণত ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নেয়ার কথা, কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে সেনাবাহিনী এখানে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।

কৌশলগতভাবে সুচি তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্রেসি (এনএলডি)’কে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছেন। তার সামনে যে দুটি বড় বাধা আবির্ভুত হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে তিনি সচেতন। এর একটি হলো জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সংগঠন – মাবাথা (জাতি ও ধর্ম সুরক্ষা সংঘ)’র তৎপরতা, অন্যটি সেনাবাহিনী। তিনি স্পিকার উইন মিয়ান্তের মাধ্যমে কেন্দ্রিয় কমিটি ও সর্বপর্যায়ের নেতাদেরকে শান্ত ও সতর্ক থাকার বার্তা পাঠিয়েছেন। স্পিকারকে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে নিজেকে আরো বিচ্ছিন্ন করতে চান না নেত্রী। মিয়ানমারের আর কোথাও অশান্তি ও বিক্ষোভ দেখা দিলে তা সেনাবাহিনী প্রধানের হাতকেই শুধু শক্তিশালী করবে।

রাজনৈতিক সংঘাত সবেমাত্র উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এর সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে। যদিও সম্প্রতি এনএনডি’র কেন্দ্রিয় কমিটি থেকে বলা হয়েছে যে ২০২০ সালের নির্বাচনের আগেই সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়টি তাদের মাথায় আছে। কিন্তু তেমনটি ঘটবে বলে মনে হয়না। এর মানে হলো আঞ্চলিক ও কেন্দ্রিয় সকল পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ এমপি নিয়োগ করা হবে সেনাবাহিনী থেকে। ফলে ২০২০ সালের পরবর্তী নির্বাচনে এনএলডি ২০১৫ সালের পুনারাবৃত্তি আশা করতে পারছে না। তখন সংবিধান পরিবর্তনের কাজটি তাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে যাবে। দেশের উপজাতি এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যে এনএলডি’র জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে উপ-নির্বাচনগুলোতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তাই মিং অং হিলাইং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন – ২৫% এমপি’র সবাই চাকরিরত সৈনিক। তার শুধু আর ২৫% এমপি’র প্রয়োজন। তবেই কেল্লা ফতে। ইতোমধ্যে তিনি সেনাপন্থী রাজনৈতিক দল ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি’ (ইউএসডিপি)’র কাছে ধর্না দিয়েছেন। এই দলের নেতা সাবেক সেনাপ্রধান থান শোয়ে। আগের সরকারের নেতৃত্ব দেন তিনি। ইউএসডিপি’র বর্তমান প্রধান থান থায়ের সঙ্গে হিলাইং নিয়মিত কথা বলেন বলে সামরিক সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে ইউএসডিপি ইতোমধ্যে একমত পোষণ করেছে। পার্লামেন্টে এই দলের এমপি’দের মনোভাবে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্প্রতি রাখাইন ইস্যুতে এনডিএসসি’র বৈঠক ডাকার আহ্বান জানায়। এতে বুঝা যায় হিলাইংয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রচেষ্টায় এই দলের সমর্থন সুনিশ্চিত। এখন সেনাপ্রধানকে শুধু আর কিছু রাজনৈতিক দলের সমর্থন আদায় করতে হবে, জাতিগত দলগুলোর প্রতিনিধিদের কাছেও যেতে হবে।

মিং অং হিলাইংয়ের রাজনৈতিক উচ্চাশা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাকে ভালোভাবে চেনেন এমন সামরিক কর্মকর্তারা এ কথা জানান। রাখাইন সমস্যা তার অবস্থানকে জোরদারে সহায়ক হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরদারের চেষ্টা করছেন তিনি। সামাজিক গণমাধ্যমে তাকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তিনি যে এই ‘নতুন সন্ধান পাওয়া’ গৌরব কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরো আশংকার বিষয় হলো একজন রাষ্ট্রনায়ক ও নেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে জাহির করতে শুরু করেছেন তিনি।

ইউরোপ, ভারত ও জাপানে তার সাম্প্রতিক সফরগুলো মিয়ানমারের একজন গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে তার অবস্থানকে উঁচু করেছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি ইউরোপের অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি ও ইটালি সফর করেন। তিনি প্রতিটি দেশের বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কোন সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে এমন সাক্ষাত স্বাভাবিক নয়। অথচ এই কয়েক বছর আগেও এসব দেশে মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো। একইভাবে ভারত ও জাপানেও তিনি প্রধানমন্ত্রী: নরেন্দ্র মোদি ও শিনজো আবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই দুটি দেশের ক্ষেত্রে কোন সফররত সেনা প্রধানের সঙ্গে সরকারের নেতাদের সাক্ষাত একটি বিরল ঘটনা।

সরকারের ভেতরের সূত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন দেশে সেনাপ্রধানের এমন অভ্যর্থনা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অং সাং সু চি। এর মধ্য দিয়ে তাকেই যেন মিয়ানমারের ‘নেতা’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো রাখাইন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অব্যাহত সমালোচনার ঝড় এবং অং সাং সু চি’র খ্যাতির ওপর ব্যক্তিগত হামলা সেনাবাহিনীর হাতে খেলার বড় রকমের অস্ত্র তুলে দিয়েছে। রাখাইন ইস্যু নেত্রীর অবস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। একই সঙ্গে দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে মিন অং হিলাইংয়ের সম্ভাবনাকে করেছে উজ্জ্বল।

 

সূত্র: south asian monitor

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন