অবিশ্বাস ও সন্দেহের আগুনে পুড়ছে ইউপিডিএফ: উজ্জল-প্রদীপন দ্বন্দ্ব চরমে

Khagrachari Picture(01) 18-02-2017

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

পাহাড়ের সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ) নেতৃত্বে মধ্যে বিশ্বাসে চির ধরেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে অনেকেটা ভেঙ্গে পড়েছে ইউপিডিএফ’র সাংগঠনিক কাঠামো। চরমে পৌঁছেছে উজ্জল ও প্রদীপনের দ্বন্দ্বও।

সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েকমাসে নিরাপত্তা বাহিনী মহালছড়ি, দিঘীনালা ও সদরে ইউপিডিএফের বিভিন্ন আস্তানায় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সুনিশ্চিত হয়ে পরিকল্পিত অপারেশন পরিচালনা করতে পেরেছে। এতে ইউপিডিএফের শীর্ষ স্থানীয় বেশ কয়েকজন সংগঠক ও নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ ও ইউপিডিএফের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দলিল, নথিপত্র জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। এতে ইউপিডিএফ নেতারা মনে করছেন দলের ভেতর থেকেই কোনো অংশ সরকারী সংস্থা সমূহকে গোপন সংবাদ পাচার করছে। একে অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলছে দলের মধ্যের বিবদমান বিভিন্ন গ্রুপগুলো।

প্রথম দিকে কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য জেএসএস(সংস্কারের) দিকে আঙ্গুল তোলার চেষ্টা করে পরিস্থিতি আড়াল করার চেষ্টা করা হলেও দ্রুত দলের ফাটল ও সন্দেহের দেয়াল বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

ইউপিডিএফ সংগঠক মিথুন চাকমা আইসিটি এক্টে গ্রেফতার হয়ে জেল গমন ও জামিন পাওয়ার পর থেকেই সন্দেহ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। ইউপিডিএফের বিভিন্ন গোপন ফোরামে জামিন অযোগ্য মামলায় মিথুন চাকমার জামিন পাওয়া নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা হয়।

Khagrachari Picture(02) 18-02-2017

একইসাথে উজ্জল স্মৃতি চাকমা, বিপুল চাকমা, সুপার জ্যোতি চাকমার মতো সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার হওয়ায় দলের একটি গ্রুপ যেমন অন্য গ্রুপের দিকে আঙ্গুল তুলেছে, ঠিক তেমনি এসব নেতাদের দ্রুত জামিন পাওয়ার ঘটনায়ও বিপরীত গ্রুপ আঙ্গুল তুলেছে অন্য গ্রুপের দিকে।

সূত্র জানায়, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে একের পর এক শীর্ষ পর্যায়ে নেতারা গ্রেফতার হওয়া ও চাঁদাবাজির ৮০ লাখ টাকাসহ সংগঠনের প্রায় দুই বস্তা গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র হাতছাড়া হওয়ার প্রেক্ষাপটে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ’র কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌছেছে। ইতিমধ্যে প্রদীপন খীসার দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এতো সাংগঠনিকভাবে কোণঠাসা উজ্জল স্মৃতি চাকমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে জেলা সমন্বয়কের দায়িত্ব। নাম প্রকাশ না করা শর্তে ইউপিডিএফ মাঠ পর্যায়ে কয়েকজন নেতা স্বীকার করেছেন,  প্রদীপন খীসাকে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাখা হয়েছে নজরধারীতে।

সূত্র আরো জানিয়েছে, বেশ কয়েক বছর আগে বিপুল অঙ্কের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে খাগড়াছড়ি জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত ইউপিডিএফ নেতা উজ্জল স্মৃতি চাকমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাঙামাটির দায়িত্বে দেয়া হয় এবং প্রদীপন খীসাকে খাগড়াছড়ির দায়িত্বে দেয়া হয়। কিন্তু অল্পকাল পরেই উজ্জল খাগড়াছড়িতে ফিরে এসে প্রদীপনকে সরিয়ে নিজেই খাগড়াছড়ির দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেই থেকে উজ্জল-প্রদীপন দ্বন্দ্বের শুরু।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ) কেন্দ্রীয় নেতা ও খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সমন্বয়ক উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা গত বছর ১৩ নভেম্বর যৌথ বাহিনীর অভিযানে পাঁচ সহযোগিসহ জেলা সদরের হেডম্যান পাড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার হন।

এ সময় রাইফেলসহ বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ ও সামরিক পোশাক উদ্ধার হয়। উজ্জল স্মৃতি চাকমার অনুপুস্থিতিতে প্রদীপন খীসা ভারপ্রাপ্ত খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সমন্বয়ক নিযুক্ত হন। সে থেকে নুতন করে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ’র নেতৃত্বে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জম্ম। উজ্জল স্মৃতি চাকমার অনুসারিদের ধারণা এ গ্রেফতারের পিছনে প্রদীপন খীসার হাত রয়েছে।

প্রায় আড়াই মাস কারাভোগের পর গত ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উজ্জল স্মৃতি চাকমা খাগড়াছড়ি কারাগার থেকে নীরবে মুক্তি পান। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পরও তিনি দীর্ঘ দিন ছিলেন অনেকটা নীরব।

গত ১০ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের জামতলী এলাকায় ইউপিডিএফ’র শীর্ষ নেতা প্রদীপন খীসার বাসায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদার প্রায় ৮০ লাখ টাকা ও প্রায় দুই বস্তা গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র উদ্ধার হলে পাল্টে যায় দৃশ্যপট।

গড়হজ

প্রদীপন খীসার অনুসারীদের সন্দেহ এ বিপুল পরিমাণ টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে চলে যাওয়ার পিছনে উজ্জল স্মৃতি চাকমার হাত থাকতে পারে। যদিওবা এ নিয়ে প্রকাশ্যে প্রদীপন খীসা ও উজ্জল স্মৃতি চাকমা কেউই মুখ খুলছে না।

তবে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, চাঁদার প্রায় ৮০ লাখ টাকা ও প্রায় দুই বস্তা গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে চলে যাওয়ায় ইউপিডিএফ’র শীর্ষ পর্যায়ে কম্পন শুরু হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী এখন এসকল নথিপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পরীক্ষা করে ইউপিডিএফের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা পেতে চেষ্টা করছে। এ ঘটনায় প্রদীপন খীসাকে সাংগঠনিক আদালতে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং তার পদ-পদবী কেড়ে নিয়ে আবার উজ্জল স্মৃতি চাকমাকে আগের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পানছড়িতে যৌথ অভিযানে বিদেশী পিস্তল, গুলি ও সেনা পোশাকসহ ইউপিডিএফ’র সামরিক শাখার দুই শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডার আটক হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা নিজেকে খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সমন্বয়ক পদবী ব্যবহার করেন। এদিকে প্রদীপন খীসা ও উজ্জল স্মৃতি চাকমার মধ্যে বিরোধ নিয়ে দু’জনের সাথে কথা বলতে বার বার চেষ্টা করা হলেও তাদের মুঠো ফোনগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি সশস্ত্র ইউপিডিএফ’র উপদেষ্টা লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা অস্ত্রসহ সরকারী বাস ভবন থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর ইউপিডিএফ সমর্থিত বেশ কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান এখন গা-বাঁচিয়ে চলছেন। গ্রেফতার আতঙ্কে তারাও সরকার বিরোধী কোনো কর্মসূচী ও বক্তব্যের দিকে পা বাড়াচ্ছেন না।

এছাড়া নেতারা অসংখ্য মামলার আসামী হওয়ার কারণে ইউপিডিএফ এখন অনেকটাই আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থেকে সময় পার করছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন