অপরিকল্পিত উন্নয়ন থামানোর লক্ষ্যে মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে মহেশখালী ঘিরে

মহেশখালী প্রতিনিধি:

মহেশখালীর উপকূলীয় এলাকা মাতারবাড়ি, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়া ঘিরে সরকারের যে আগামীর উন্নয়ন পরিকল্পনা সেই পরিকল্পনায় ভূমির বরাদ্দ পেতে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যেই শুরু হয়েছে এক ধরনের প্রতিযোগিতা। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, দিনে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি প্লান্টসহ আরও অনেক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে মাতারবাড়ি ঘিরে। তাই ওভারলেপের আশঙ্কায় মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে মহেশখালী ঘিরে। জাইকার অর্থায়নে আগামী মাস থেকে শুরু হচ্ছে এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ।

মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা স্বীকার করে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য ( প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, মাতারবাড়ি ঘিরে যেভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ভূমি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তাই এতে ওভারলেপিং হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইসাথে পরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমও ব্যাঘাত হতে পারে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে জাইকার পক্ষ থেকে মহেশখালী এলাকাকে ঘিরে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে।

সেই মাস্টারপ্ল্যানে কি থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেই মাস্টারপ্ল্যানে ভূমির পরিমাণ এবং কোন ভূমি কি কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এর দিক নির্দেশনা থাকবে। এর মাধ্যমে পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে।
কবে নাগাদ এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন তৈরির কাজ শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্দরের প্রকল্পের আওতায় এই মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে। জাইকার অর্থায়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আগামী মাস থেকে কাজ শুরু করে আগামী মার্চের মধ্যে শেষ করবে।

মহেশখালী ও কুতুবদিয়াকে ঘিরে বিনিয়োগের শুরু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাঁচামালের জন্য কয়লার প্রয়োজন হবে, আর কয়লার জন্য বেশি ড্রাফটের বড় জাহাজ ভিড়তে হবে মহেশখালীতে। তাই এই জাহাজের জন্য তৈরি করা হচ্ছে বন্দরের চ্যানেল। এখন সেই চ্যানেলকে ব্যবহার করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায় নির্মিত হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এর পাশাপাশি দিনে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি এলএনজি প্ল্যান্ট বসেছে মহেশখালীতে।

গত ২৪ এপ্রিল এলএনজিবাহী জাহাজও ভিড়েছে মহেশখালীতে। এখন তা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের পালা। পেট্রোবাংলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেটর এনার্জি লিমিটেড এই ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি আসছে সামিটের আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া পাইপ লাইনে রয়েছে কুতুবদিয়ায় দুই ভারতীয় কোম্পানি পেট্রোনেট ও রিলায়েন্সের ল্যান্ডবেইজড দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প। এই দুই প্রকল্প থেকে দৈনিক আসবে আরও ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া মহেশখালীতে ভূমি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে সামিটকে। এলএনজি প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য এই বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।

এদিকে বেজার সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে দেশের বিশিষ্ট শিল্পগ্রুপ টিকে গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসপিএল পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের (এসপিসিএল) সাথে ৪১০ একর জমির বরাদ্দ নিয়ে বেজার চুক্তি হয়েছে। এই জমিতে জেটি সুবিধাসহ পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি, পেট্রোলিয়াম পণ্য মজুদগার, এলপিজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এই প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে কর্মসংস্থান হবে ১০ হাজার লোকের। এতে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে দক্ষিণ কুরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পগ্রুপ এসকে গ্যাস এবং প্রকল্পটি ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
অপরদিকে উপকূলীয় বন বিভাগ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন,‘ মহেশখালীতে বেজাকে প্রায় ৮ হাজার একর ভূমি দেয়া হয়েছে। বেজা সেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিচ্ছে। এছাড়া মহেশখালীর পাহাড়ে ইস্টার্ন রিফাইনারিকে দেয়া হয়েছে রিজার্ভ ট্যাংক নির্মাণের জন্য ১৯০ একর জায়গা।‘

জানা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেজার কাছ থেকে ভূমি বরাদ্দ নিচ্ছে। কিন’ উপকূলীয় ভূমি ঘিরে কোনো জরিপ বা পরিকল্পনা না থাকায় সমন্বয়হীন উন্নয়ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এবিষয়ে কথা হয় মহেশখালীর সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের সাথে। তিনি বলেন,‘ মহেশখালী ঘিরে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ আসছে। সেই বিনিয়োগ যাতে পরিকল্পিত হয় এবং ওভারলেপিং না হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাবেক মুখ্য সচিব ও বর্তমানে এমডিজি বাস্তবায়ন এর মুখ্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তিনি পুরো বিনিয়োগ সমন্বয় করছেন।’

তিনি আরও বলেন, এছাড়া জাইকার অধীনে দক্ষিণ চট্টগ্রাম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী হিসেবে একটি মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে। সেই মাস্টারপ্ল্যান হয়ে গেলে আর ওভারলেপ কিংবা সমন্বয়হীন হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।

উল্লেখ্য, ভোগৌলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। ৩৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী এবং ২১৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কুতুবদিয়া ঘিরে রয়েছে সাগর। বছরের পর বছর যে জমিতে শুধু লবণ চাষ করা হতো এখন সেই জমিতে গড়ে উঠতে যাচ্ছে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা। সমুদ্রের উপকূলের সৌন্দর্য্যকে কাজে লাগিয়ে হতে যাচ্ছে ইকো ট্যুরিজম। সমুদ্রের গভীরতাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক বন্দরের আড়ালে হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর, হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। ভিড়ছে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসবাহী (এলএনজি) জাহাজ, পাইপলাইনে রয়েছে আরও এলএনজি ও এলপিজি কেন্দ্র। আর সেই কয়লা ও গ্যাসকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে শিল্প কারখানা। আগামীর শিল্পনগরী হয়ে উঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা এই এলাকাটির।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন