parbattanews

২৯ এপ্রিল : খাগড়াছড়ি গণহত্যার ৩২ বছর

1986-01
আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া
পাহাড় অরণ্য হ্রদে ঘেরা সবুজ সমারোহে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। অপরূপ সৌর্ন্দয্যের এ জনপদ অশান্তির আগুনে জ্বলছে প্রতিদিন।

হত্যা, গুম, অপহরণ, খুন আজ নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ মহামারি আকার ধারণ করেছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। সাম্য মানবিকতা মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ সকল সম্প্রদায়ের সাথে সমান আচরণই ছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতি। অথচ আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সমাজ রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে একটি অনগ্রসর সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়ী উপ-জাতিদেরকে বিভিন্ন সংঘাত পরিহার করে বাঙালিদের সাথে মিলেমিশে দেশ গড়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র তুলে নিতে বলেছিলেন। শুরু হলো সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত।

প্রতিবেশী ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে হাজার হাজার উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ট্রেনিং করিয়ে, অস্ত্র গোলা বারুদ দিয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নিধনের নৃশংস তান্ডব শুরু করা হলো। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী তৎকালীন বিডিআর জওয়ানদের জীবন দানসহ সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা ও দেশরক্ষার ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মনবলের প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও বাঙালি নিধনের ভয়াবহ নির্মমতা থেমে থাকেনি।

১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিলের এ দিনে তথাকথিত শান্তিবাহিনী নামক সন্ত্রাসীরা বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। সে দিন রাস্তাঘাট, হাট-বাজারে, ঘুমন্ত পল্লীতে হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে রাতের আঁধারে বাঙালিদের ঘরবাড়ীতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষকে পুরিয়ে মারা, ঘরের গরু ছাগল হাস মুরগী ইত্যাদি সম্পদ সহ কোটি টাকার মালামাল ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয়নি, বাবা মার সামনেই অবুঝ শিশুদের কে ধরে নিয়ে পাথরে আঘাত করে আবার উপর দিকে নিক্ষেপ করে নিচে দাড়াঁলো চাকুতে ঠেঁকায়, যা সাপ্রতিক মায়ানমারের বৌদ্ধাদের মুসলমান রোহিঙ্গা নিধন এর কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। সে দিন সন্তু বাহিনী এরূপ অনেক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়ে রাতেই নিরস্ত্র উপজাতীয়দেকে জোর পূর্বক ভারতে নিয়ে যায়।

ঐ রাতে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার শুধু তানৈক্য পাড়া, আসালং এবং তাইন্দং বাজার সহ মোট ৪৯ জনের লাশ পাওয়া যায়। শতাধিক আহত হয়েছিল যাদের মধ্যে অনেকেই আজ পঙ্গু হয়ে দূর্বিসহ জীবন যাপন করছে।

একই দিন অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে ২৯ এপ্রিল দিবাগত রাত আনুমানিক ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত সময়ে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং, চেঙ্গী, পানছড়ি, লতিবান, উল্টাছড়ি ৫টি ইউনিয়নের ২৪৫টি গ্রামের প্রত্যেকটি বাঙ্গালি গ্রামে অগ্নি সংযোগ সহ লুটতরাজ, সামনে বাঙ্গালী যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে, বাঙ্গালী নারীদের গণধর্ষণ ও পরে হত্যা, নরকীয়তা সৃষ্টি করেছিলো তথাকথিত শান্তিবাহিনী।

অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে ২৯ এপ্রিল দিবাগত রাত আনুমানিক ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত সময়ে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং, বোয়ালখালী, কবাখালী, দিঘীনালা, বাবুছড়া ৫টি ইউনিয়নের ২৪৫টি গ্রামের প্রত্যেকটি বাঙ্গালী গ্রামে অগ্নি সংযোগ সহ লুটতরাজ, সামনে বাঙ্গালী যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে, বাঙ্গালী নারীদের গণধর্ষণ, নরকীয়তা সৃষ্টি করেছিলো ৩৮ হাজার বাঙ্গালীর হত্যাকারী খুনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনী ও উপজাতি সন্ত্রাসী হায়নারা।

খাগড়াছড়ির এ গণহত্যার ৩২ বছর পূর্তির এদিনে আজ আমাদের দাবি হল -২৯শে এপ্রিলে নিহত শহীদদের স্বরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করে সেখানে শহীদদের নামের লিষ্ট টানিয়ে তা সংরক্ষণ করা, শহীদের প্রতি পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং-২৯শে এপ্রিলে হত্যাকান্ডে দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার বাদী হয়ে একটি মামলা করে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দ্বারা তদন্ত করে তথাকথিত শান্তি বাহিণীর সদস্যদের দৃষ্টান্ত মূলক বিচার এবং নির্দেশ দাতা হিসেবে সন্তু লার্মার ফাঁসী দেয়া। সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধি করা, অস্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা সহ পার্বত্য নাগরিক পরিষদের নিম্নোক্ত ৮ দফা দাবী মেনে নেয়া।

১। ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত তথাকথিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসকারী উপজাতী ও বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী ও সংবিধানের সাথে ধারাসমূহ বাতিল করে বাস্তবতার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্রগ্রামের সকল জনগণের মাঝে শাসনতান্ত্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

২। পার্বত্য চট্র্রগ্রামের উপজাতিদের আদিবাসী স্বীকৃতি প্রাপ্তির অযৌক্তিক দাবী ও আদিবাসী ইস্যু কিছু মিডিয়া, এনজিও, আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং তথাকথিত সুশীল ব্যাক্তির/ ব্যাক্তিদের অপপ্রচার বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যাবস্থা নিতে হবে, পার্বত্য চট্রগ্রামে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মত আলাদা খ্রীষ্ঠান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সকল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বন্ধ করার পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যাবস্থা নিতে হবে।

৩। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ অসংবিধানিক হওয়ায় সেটিকে অবৈধ ঘোষণা পূর্বক পরবর্তীতে প্রস্তাবিত সকল সংশোধনীসহ আইনটিসহ আইনটি বাতিল করতে হবে। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় প্রচলিত ভূমি আইনের মাধ্যমে সকল ভূমি সমস্যার সমাধার করতে হবে।

৪। শিক্ষা, শিক্ষাবৃত্তি ও চাকুরী ক্ষেত্রে উপজাতি কোটা বাতিল করে জনসংখ্যানুপাতে  পার্বত্য কোটা চালু করতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় শুধুমাত্র উপজাতি ছাত্রাবাসের পরিবর্তে উপজাতি ও বাঙালী সকল সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট আসনসংখ্যা বিশিষ্ট ছাত্রবাস গড়ে তুলতে হবে। শুধুমাত্র উপজাতিদের জন্যে করমুক্ত ব্যবসা সুবিধার পরিবর্তে সকল সম্প্রদায়ের ব্যবসায়াীদেরকে একই সুবিধার আওতায় আনতে হবে।

৫। বর্তমান জেলা পরিষদ, পার্বত্য শরনার্থী পুনর্বাসন টাস্কফোর্স, পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও আঞ্চলিক পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ো নির্বাচন দিতে হবে। চেয়ারম্যান পদ সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মোক্তকণপুর্বক সকল পর্যায়ে বঙালী প্রতিনিধির পদ সংখ্যা জনসংখ্যানুপাতে বৃদ্ধি করতে হবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। সকল সরকারি নিয়োগ ও বদলি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে হতে হবে।

৬। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী নিরীহ, নিরস্ত্র, গরীব ও অসহায় বাঙ্গালীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং নির্বিচারে সীমাহীন চাঁদাবাজি রোধে কোনভাবেই অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা যাবে না। নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসমুহে সেনাক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। স্থানীয় পুলিশ বিভাগ কোনভাবেই উপজাতি নেতৃত্বাধীন জেলাারিষদের হাতে ন্যাস্ত করা যাবে না।

৭। ৩০ হাজার বাঙালীর খুনী, দেশদ্রোহী সন্তু লারমা ও তার দোসরদেরকে আঞ্চলিক পরিষদ থেকে অপসারণ করে বাঙালী হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। জেএসএস, ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থি এবং তাদের সমর্থিত অঙ্গ সংগঠনসমুহকে উগ্রপন্থি ঘোষণা করে নিষিদ্ধকরণপূর্বক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রয়োজনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। উপজাতীয় চাঁদাবাজী, অপহরণ বাণিজ্য, হত্যা, পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ষড়যন্ত্র ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৮। ক) ২৮২২০ পরিবার গুচ্ছগ্রামবাসী বাঙ্গালীদের ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরনার্থীদের ন্যায় সুবিধাদি দিয়ে ভূমিসহ পূনর্বাসন করতে হবে এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বৃটিশ হিলট্রাক্টস্ ম্যানুয়াল এ্যাক্ট-১৯০০ বাতিল করতে হবে।
খ) শিক্ষাঙ্গনসহ সকল ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজী এবং দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রে শান্তি বাহিনীর যোগ্য উত্তরসুরীবলে খ্যাত পাহাড়ী(চাকমা!!) ছাত্র পরিষদ এবং স্বঘোষিত সিএইচটি কমিশনকে বে-আইনী ও নিষিদ্ধ করতে

লেখক: সভাপতি, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ

Exit mobile version