টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তে মিয়ানমারে প্রচণ্ড গোলাগুলি: ১৪৬ রোহিঙ্গা পুশব্যাক

টেকনাফ প্রতিনিধি:

টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যে মুসলমানদের উপর অব্যাহত জুলুম নির্যাতনের ঘটনায় বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের সাথে সে দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির ঘটনার পর ভোর রাতে শত শত রোহিঙ্গা নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। তম্মধ্যে ১৪৬জনের একটি দলকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের সময় বিজিবি সদস্যরা তাদেরকে আটক পূর্বক পুশব্যাক করে।

টেকনাফ-২ বিজিবির সিও লে. কর্ণেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আমরা সব সময় প্রস্তুত রয়েছি। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে পুশব্যাক করা হয়েছে। সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন এবং সতর্ক রাখা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলার সীমান্ত এলাকার নাফ নদীর তীরে বসবাসকারী বাসিন্দাগণ জানান শুক্রবার(২৫ আগস্ট ) রাত ১টার পর থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শুনা যায়। তা সকাল ৬টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যের উত্তরে ঢেঁকিবনিয়া থেকে দক্ষিণে কুয়ারবিল পর্যন্ত বিশাল এলাকায় একযোগে গোলাগুলি চলে। প্রচণ্ড গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। গভীর রাতে প্রচণ্ড গুলির শব্দে টেকনাফ সীমান্ত এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

শুক্রবার সকালে টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় ঘুরে নাফ নদীতে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যের উত্তরে ঢেঁকিবনিয়া থেকে দক্ষিণে কুয়ারবিল পর্যন্ত বিশাল এলাকায় ছোটবড় কমপক্ষে ২৪টি চৌকি-পোস্টে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান সলিভেশন আর্মি(আকসা) সেদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। শত শত রাউন্ড গুলি, ব্রাশ ফায়ার এবং সম্মিলিত কান্নার শব্দ শুনা যায়।

এদিকে ২৫ আগস্ট ভোর সকালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ১৪৬জনের নারী শিশু পুরুষ ও বৃদ্ধের একটি রোহিঙ্গা দল টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের সময় বিজিবি সদস্যরা তাদেরকে আটক করে। এসব রোহিঙ্গাদেরকে ২৫ আগস্ট সকাল ১১টায় দিকে টেকনাফ-২ বিজিবির সিও লে. কর্ণেল আরিফুল ইসলাম, টুআইসি মেজর শরিফুল ইসলাম জোমাদ্দার ও বিজিবির সদস্যরা উলুবনিয়া সীমান্তে ঝাউবাগান পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে পুশব্যাক করেন।

অপর দিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা ২৪টি পুলিশ পোস্টে সমন্বিত হামলা চালানোর পাশাপাশি একটি সেনা ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করার পর পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়। রাতভর চলা ওই সংঘর্ষে অন্তত ৩২জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২১জন রোহিঙ্গা, ১০জন পুলিশ এবং ১জন সেনা সদস্য রয়েছে।

শুক্রবার (২৫ আগস্ট) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বরাতে এ তথ্য জানা গেছে। কিছু এলাকায় এখনও লড়াই চলছে। গত বছরের অক্টোবরে একই ধরনের হামলায় ৯ পুলিশ নিহত হওয়ার পর রাখাইন রাজ্যে বড় আকারের সামরিক অভিযান হয়েছিল। তখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ ওঠে। সেই সময় থেকে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সামিল বলেও উল্লেখ করে।

চলতি মাসে রাথেটং শহরে নতুন করে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ এলাকায় রাখাইন ও রোহিঙ্গা দুই সম্প্রদায়েরই বসবাস। সেকারণে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ইতিমধ্যেই বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা বাহিনী ও রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ হলো।

মিয়ানমার সরকারের তথ্য বিষয়ক কমিটির এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের বাঙালি উল্লেখ করে বলা হয় বাঙালি উগ্রপন্থীরা রাত একটার দিকে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা মংদোর একটি পুলিশ স্টেশনে হাত বোমা বিস্ফোরণ করেছে এবং বেশ কয়েকটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়েছে। ২৪টি পুলিশ পোস্ট হামলার শিকার হয়েছে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়, প্রায় ১৫০ রোহিঙ্গা একটি সামরিক ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে সেনাবাহিনী তাদেরকে প্রতিহত করে। সেনাবাহিনী জানায়, বিদ্রোহীদের হামলা এবং পাল্টা অভিযানে এক সেনা সদস্য, ১০ পুলিশ ও ২১ বিদ্রোহী নিহত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

রাখাইন রাজ্য নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের পক্ষ থেকে এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার একদিন পরই পুলিশের ওপর হামলা হলো। ওই প্রতিবেদনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর আরোপিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে কফি আনান কমিশন। পাশাপাশি বিশ্বের সব থেকে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত ওই জনগোষ্ঠীর মানুষের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদেরকে ‘বিশ্বের একক বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যদি স্থানীয় জনগণের বৈধ অভিযোগগুলি উপেক্ষা করা হয় তবে তারা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগদানের প্রতি ঝুঁকে পড়বে।

কমিশনের আশঙ্কা, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত না করা হলে এবং এ সম্প্রদায়টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক থেকে গেলে উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য জঙ্গিবাদের উর্বর ঘাঁটিতে পরিণত হবে। গত বছরের অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি রাখাইন রাজ্যের অস্থিরতা খতিয়ে দেখতে গঠিত একটি কমিশনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কফি আনানকে অনুরোধ করেন। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তীব্র আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি এই কমিশন গঠনে বাধ্য হন।

দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চলে আসছে রাখাইন বৌদ্ধ ও রাজ্যটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে। দেশটিতে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়, এমনকি দেশটির সরকার তাদের প্রাচীন নৃ-গোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদীরা জোর দিয়ে বলে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। তারা রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ‘বাঙালি’ বলে থাকে। তিক্ততার ফলে ২০১২ সালে রাখাইনে ভয়াবহ মুসলিম বিরোধী সহিংসতা সংঘটিত হয়। ১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।

টেকনাফ-২ বিজিবির সিও লে. কর্ণেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আমরা সব সময়  প্রস্তুত রয়েছি। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে পুশব্যাক করা হয়েছে। সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন এবং সতর্ক রাখা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন