parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন সমস্যা ও সম্ভাবনা


ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান::
পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনাময় এক জায়গা। এর কারণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূপ্রকৃতি। এই ভূপ্রকৃতির সাথে আমরা যারা সমতল ভূমির মানুষ তাদের পরিচিতি কম। মানুষ সবসময়ই নতুন কিছু দেখতে চায়, জানতে চায়। যার ফলে আমরা যারা সমতল ভূমির বাসিন্দা, আমাদের কাছে দুইটা জিনিস খুবই আকর্ষণীয়। একটা হচ্ছে পাহাড়-পর্বত, আরেকটা হচ্ছে সমুদ্র। কারণ এই দু’টি আমাদের নেই। এজন্য দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ হয় পর্বতে না হয় সমুদ্রে ছুটে যায়। এ কারণে আমরা বলবো পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ভূপ্রকৃতি আছে, প্রাকৃতিক যে আকর্ষণটা আছে এটা অতুলনীয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা খুব ভালো পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু প্রকৃতিরই আকর্ষণ নয়, এর সাথে আরেকটা সুন্দর জিনিস যোগ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২/১৩টার মতো উপজাতি আছে এবং এই উপজাতিদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি এখনকার যুগ হচ্ছে experience ট্যুরিজমের। আমরা এখন শুধুই সমুদ্র দেখার চেয়ে experience পাওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে ছুটে যাই। এই যে উপজাতি যারা আছে তারা কীভাবে জীবন-যাপন করে তাদের লাইফ স্টাইলটা কেমন, ওদের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে যে বাসাগুলো আছে ওখানে আমাদের থাকতে ইচ্ছে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি ফাইভ স্টার হোটেল করে দেয়া হয় তাহলে আমরা সেখানে থাকবো না। ফাইভ স্টার মানেই হলো ইট-সিমেন্ট, পাথরের নির্মিত আবাস। এগুলো একটা কারাগারের মতো। যা আমরা শহরে সবময়ই ব্যবহার করি। তাই আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে থাকতে চাই স্থানীয় ওই ধরনের বাড়িতে।

মানুষ এখন খাওয়া-দাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যায়। খাওয়ার জন্য মানুষ এখন ইস্তাম্বুলে, থাইল্যান্ডে বা দুবাইয়ে যায়। নতুন কিছু টেস্ট করার জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েও কিন্তু আমরা এমন নতুন নতুন খাবার খেতে পারি বা খেতে পাই। সেখানে বিভিন্ন ধরনের খাবার আছে, যেটা তাদের নিজস্ব খাবার, নিজস্ব ফুড। তাহলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় জায়গা।

এখন একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি, সেটা হচ্ছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যুরিজম এখন পর্যন্ত সে রকমভাবে উন্নত হয়নি। না হওয়ার কারণটা কী? প্রথমে যে কারণটা আমরা বলতে পারি, যদি বলি একটা পর্যটন স্থান আছে, একটা পর্যটন এসেট কোথাও আছে, কিন্তু সেখানে যদি আমরা না যেতে পারি তাহলে সেটা থাকা আর না থাকার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই খারাপ। যার কারণে আমরা সেখানে তেমনভাবে যাই না। বান্দরবানে যান অথবা যেখানেই যান না কেন ওখানে যাওয়ার কোন সরাসরি রাস্তা নেই। আর গাড়িতে যেতে হবে সেই ১২/১৩ ঘণ্টার পথ। আপনি যদি প্লেনেও যান, সেই চট্টগ্রাম থেকে যেতে একই রকম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। যাতায়াত অবস্থা খুবই খারাপ। যার ফলে প্রত্যাশার চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যুরিস্ট খুব কমে যাচ্ছে। তাও কিন্তু কম না, আমাদের হিসেব মতে, শুধু মাত্র বান্দরবানে ২০১৪ সালে ৭ লক্ষ ট্যুরিস্ট গেছে। এটাও কম না, কিন্তু প্রত্যাশাটা আরও বেশি।

রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির চেয়ে পর্যটকদের কাছে বান্দরবান আকর্ষণীয়। কারণ খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটির দুই জেলার যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু দুইটাতেই দেখার মতো অনেক কিছু আছে। তুলনামূলকভাবে বান্দরবানের যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো বিধায় আমাদের লোকজন বান্দরবানে বেশি যায়। তাহলে বলা যায়, যাতায়াত ব্যবস্থা একটা কারণ।

দুই নম্বর কারণ হতে পারে, ট্যুরিস্টরা যায় না- কেননা সেখানে থাকার জন্য, খাওয়ার জন্য, টয়লেটের জন্য ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। যার জন্য বেশিরভাগ ট্যুরিস্টরা যায় না। যেমন, বগালেকে গেলে টয়লেটের জন্য অনেক দূর যেতে হয়। থাকার জন্য কোন ব্যবস্থা নেই, সবাইকে ফ্লোরিং করতে হয়। আর যেহেতু ট্যুরিস্টরা যায় না সেহেতু তাদের জন্য আবাসন, খাবার ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থা, রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা, টয়লেটের ব্যবস্থা এগুলোর কোনোটাই নেই বা তৈরি হয়নি। যার কারণে আমরা বেশি যাই না।

তিন নম্বর কারণ যেটা বলতে পারি, বান্দরবানে ট্যুরিজম ডেভেলপ করার জন্য ১৯৯৭ সালে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক শান্তিচুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটা হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল আছে। তিনটা হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের মধ্যে একটা হচ্ছে রাঙ্গামাটি হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল, আরেকটা হচ্ছে বান্দরবান হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল, আরেকটা হচ্ছে খাগড়াছড়ি হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল। তিনটা হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল করা হয়েছে। আর তিনটা হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের সেখানে ট্যুরিজমকে ডেভেলপ করার জন্য। আমাদের এখানে যেমন পর্যটন মন্ত্রণালয় আছে, অথবা অন্যান্য সংস্থা যেগুলো ট্যুরিজমের সাথে রিলেটেড আছে, যেমন ফরেস্ট্রি, এগুলোর কেউ ওখানে গিয়ে কাজ করতে পারছে না। কারণ ট্যুরিজমকে ডেভেলপ করার জন্য হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাই বাহির থেকে কেউ গিয়ে কিছু করতে পারছে না। কিন্তু ওই হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল এখনো ভালো মতো গড়ে উঠতে পারেনি। তাদের অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি, তাদের দক্ষ জনবল নেই, তাদের কোন মিশন নেই, তাদের কোনো ভিশন নেই। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্যুরিজমটা সবসময় অবহেলিত থেকে গেছে।

আরেকটা কারণ বলা যেতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যুরিজম ডেভেলপ করছে, কিছুটা লিমিটেড স্কেলে। কেমন লিমিটেড স্কেলে? যেমন যখন হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল কিছু করছে না বা পারছে না করতে, তখন বাহির থেকেও পর্যটন মন্ত্রণালয় বা অন্য কেউ ওখানে গিয়ে কিছু করছে না। তখন তো ট্যুরিজম ডেভেলপ করতেই হবে কাউকে না কাউকে। এজন্য দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন এই তিনটা সরকারি যে উইং বা রাষ্ট্রযন্ত্র আছে, তারা তাদের নিজের মতো ট্যুরিজম ডেভেলপ করার চেষ্টা করছে। এখন তারা নিজেদের মতো করার কারণে, এখানে কোন ট্যুরিজম প্ল্যান হচ্ছে না। কক্সবাজার যেমন প্ল্যান না থাকার কারণে যেখানে সেখানে হোটেল গড়ে উঠেছে, যার কারণে কক্সবাজার কিন্তু এখন নষ্ট হয়ে গেছে। বান্দরবানেও এখন এমন কিছু বিষয় হচ্ছে, দেখা যাবে যে আর কিছুদিন পরে সেটাও নষ্ট হয়ে যাবে।

সাজেক গেলে দেখতে পাবেন সেখানে এখন এমন অপরিকল্পিতভাবে কিছু কটেজ গড়ে উঠছে যা সেখানকার সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সাজেকও দেখা যাবে আর কিছুদিন পর কক্সবাজারের মতো অবস্থা হবে। এই তিনটা রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের নিজেদের মতো ট্যুরিজমকে ডেভেলপ করছে। যেখানে কোন প্ল্যান নেই, যেখানে কোন উদ্যোগ নেই।

এছাড়া কিছু অভাব রয়েছে, পানির প্রচ- অভাব, জলপ্রপাত থেকে পানি উঠিয়ে নিয়ে আসতে হয়। আর শীতকালে জলপ্রপাত শুকিয়ে যায় তাতে পানির খুব অভাব সৃষ্টি হয়। ট্যুরিস্টদের পানির দরকার হয়, পানি না পেলে টুরিস্ট যাবে কেন?

এছাড়া বিদ্যুতের অভাব আছে, পার্বত্য এলাকা হওয়ার কারণে বহু জায়গায় বিদ্যুৎ যায় না, এছাড়া যে জায়গাগুলোতে বিদ্যুৎ গেছে তা সব সময় থাকে না। সুতরাং বিদ্যুতের বড় একটা অভাব।
তিন নম্বর যে অভাব, সেটা হচ্ছে ওখানকার স্থানীয় যে মানুষরা আছে তাদের ট্যুরিস্টদের প্রতি স্বাভাবিক একটা সন্দেহ রয়েছে। তারা ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি না। আর ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি না হলে আমি সেখানে যাব কেন? আমি তো ওখানে গিয়ে কারো খারাপ ব্যবহার আশা করব না। আমি ওখানে গিয়ে অপহৃত হব সেটাও আশা করি না। অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে, সেটাও আশা করি না। তারা এখন পর্যন্ত ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি না, এজন্য আমি তাদেরকেও দোষ দেবো না। তাদের মাথায় ট্যুরিস্ট কনসেপ্ট নেই, বা অশিক্ষিত হওয়ার কারণে তাদের মাথায় এটা ঢুকানো সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার এখন কিছু কাজ করাচ্ছে। এটা অবশ্যই একটা ভালো দিক।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্যুরিজম নিয়ে আমার শেষ কথা হল, এটা হচ্ছে অপার সম্ভাবনাময় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। আমরা ইচ্ছে করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দারবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এ তিনটি জেলাকে নিয়ে একটা টোটাল প্ল্যান বণ্টন করতে পারি, তবেই এটাকে আমরা বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড বানাতে পারব। আমরা ওখানে ফাইভ স্টার হোটেল চাই না। আমরা ওখানে বড় বড় হোটেল চাই না। আমরা ওখানে ওদের মতো করে মোটেল বা কটেজ অথবা ছোট ছোট রিসোর্ট চাই। যেখানে বাহির থেকে দেখলে সাধারণ মনে হবে, কিন্তু ভিতরে ঢুকলে আধুনিক সব উপকরণ পাওয়া যাবে। আর এগুলো করতে হলে প্রথম অসুবিধা হবে পানি। পানি সাপ্লাই এর জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। হয় সাঙ্গু নদী থেকে পাইপ এর মাধ্যমে, অথবা যেখানে লেক আছে সেখান থেকে পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আরেকটা হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা।

পানি এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা যদি করে দেয়া যায় তবে এখানকার বাসিন্দাদেরও লাইফস্টাইল চেঞ্জ হবে, ট্যুরিস্টরা গিয়েও আরামে থাকতে পারবে, আরো বেশি টাকা খরচ করে আসবে। এই দুইটা অবশ্যই সরকারকে করে দিতে হবে। সর্বশেষটা হলো যাতায়াত ব্যবস্থা, তা থাকতেই হবে।
এছাড়া আরেকটা জিনিস যেমন দীঘিনালা থেকে সাজেক পর্যন্ত সেনাবাহিনী কর্তৃক ট্যুরিস্টদের স্কট করে। এটার কি দরকার আছে? তেমন তো কোনো সমস্যা আমার চোখে পড়েনি। গত কয়েক বছরের মধ্যে খারাপ ধরনের কোন ঘটনা ঘটতে শুনিনি। এসব বিষয় ভেবে দেখতে হবে। আর অস্ত্র দিয়ে ভালো কিছু অর্জন সম্ভব নয়, করতে হবে ভালোবেসে মোটিভেশনের মাধ্যমে।

লেখক: প্রফেসর, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, বর্ষ ১, সংখ্যা ২ ও ৩।

Exit mobile version