parbattanews

শান্তিচুক্তির ২০ বছরেও পাহাড়ে আসেনি শান্তি

মনিরুজ্জামান মনির॥

আগামী ২ ডিসেম্বর শনিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২০ বছর পূর্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যে আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই চুক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আজ পর্যন্ত পূরণ হয়েছে কি? ২০ বছরে পাহাড়ের উপজাতি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠি আদৌ শান্তির ঠিকানা পেয়েছে কি না সেই প্রশ্ন আজ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলাবাসীর ঘরে ঘরে।

পাহাড়ের আজও বেআইনী অস্ত্রের ঝনঝনানী, বন্দুক যুদ্ধ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মুক্তিপণ, গুম ইত্যাদি অব্যাহতভাবে চলে আসছে। কিন্তু কেন? আমরাতো এই চিত্র দেখতে চায়নি। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিচুক্তির পরে প্রতিটি উপজাতি বাঙালির ঘরে ঘরে শান্তির ফোয়ারা বইবে। অথচ সেখানে আজও দেখছি রক্তের ঝরণাধারা। কেন এই রক্তপাত? কেন এই খুনাখুনী? জেএসএস সন্ত্রাসীরাই আজ জীব হত্যায় লিপ্ত, হিংসা, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি জেএসএস সন্ত্রাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কেন? আমরাতো সন্তুবাবুর কাছে এই চিত্র কামনা করি নাই। কোথায় আমাদের সেই শান্তির শ্বেত কপোত? জেএসএস নেতারা দয়া করে এর জবাব দিবেন কি?

বাংলাদেশের এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ৫০৯৩ বর্গমাইল বিস্তৃত সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা, বিল-ঝিল-হ্রদ-পাহাড় বেষ্টিত দেশের এক দশমাংশ ভূমি। চেঙ্গী, মাইনী, কর্ণফুলী, কাসালং বিধৌত এই পার্বত্যবাসী জনগণ কেমন আছে? পাহাড়ে শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তা আছে কি? এসব প্রশ্নে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের বিবেকবান জনতা।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বহু আশা-আকাঙ্ক্ষার ফসল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। দীর্ঘদিনের সন্ত্রাস, যুদ্ধ বন্ধ হবে, চাঁদাবাজী, নৈরাজ্য, গোলাবারুদের ধোঁয়া শেষ হবে, এই ছিল পার্বত্যবাসী উপজাতি ও বাঙালিদের একমাত্র আশা। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে পাহাড়ে আজো শান্তির সু-বাতাস প্রবাহিত হয়নি, জনগন শান্তির শ্বেতকপোতটির দেখা আজো পায়নি। কিন্তু কেন?

শান্তি কেন আসছে না ?
পাহাড়ে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে উপজাতীয় রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসী তথা জুম্ম লিবারেশন আর্মী (শান্তিবাহিনী) সব অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আসলেই কি জমা দিয়েছিল? সন্তুু লারমা বাহিনী কি প্রকৃত-ই বাংলাদেশ সরকারের কাছে সেদিন আত্মসমর্পন করেছিল? নাকি লোকদেখানো মহড়া হিসেবে সেদিন কোন নাটক হয়েছিল। সন্তু লারমারা ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ আত্মসমর্পন করে তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম, গোলাবারুদ ও সমস্ত শান্তিবাহিনীর সদস্যকে নিয়ে একসাথে, এক নিয়মে এবং একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নাই। তাছাড়া, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকারের কাছে একটি সশস্ত্র রাষ্ট্রদ্রোহী বিদ্রোহী বাহিনী (জুম্ম লিবারেশন ফ্রন্ট -শান্তিবাহিনী) আত্মসমর্পনের পর কি নিয়মনীতি প্রচলিত আছে। তা কিন্তু সন্তুু লারমার ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে।

বিশ্বের কোথাও আত্মসমর্পনকারী রাষ্ট্রদ্রোহী বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পনের পর এতটা স্বাধীনতা, সুযোগ সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করা হয় না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) পাকিস্তানী পূর্বাঞ্চল সেক্টরের সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেঃ এ কে নিয়াজী আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং আরোবার কাছে আত্মসমর্পন করেছিল। সেক্ষেত্রে নিয়াজীকে শুধুমাত্র জাতিসংঘ সনদ মোতাবেক আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মোতাবেক আচরণই করা হয়েছিল মাত্র। নিয়াজী আত্মসমর্পনের পর স্বদেশে ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত মিডিয়ার সাথে কোন কথা বলতে পারে নাই, পুনরায় অস্ত্র ধরার হুমকি দেয় নাই, সরকারের কোন সমালোচনা করতে পারে নাই।

কিন্তু একই ধাঁচে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩০ হাজার বাঙালী হত্যাকারী, নিরীহ জনগনের উপর ব্রাশফায়ার চালিয়ে হত্যা সংঘটিত, বহু সেনা-পুলিশ আনসার-বিডিআর এর ঘাতক সন্তুু লারমা আত্মসমর্পনের পর কী আচরণ করছে? কথায় কথায় সন্তুু বাবুরা পুনরায় অস্ত্র ধরার হুমকি দিচ্ছে। তারা ঢাকায় সুন্দরবন হোটেল, ইঞ্জিনিয়ারস ইষ্টিটিউট মিলনায়তন, জাতীয় প্রেসক্লাব, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ তিন পার্বত্য জেলায় অবাধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপ প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

সন্তুু বাবুরা নিজেদের বলছে আদিবাসী, জুম্ম জাতি, তাদের মুখপত্র জুম্ম কন্ঠ, জুম্ম নিউজ বুলেটিন, রাডার, সেটেলাইট, তাদের বাহিনীর নাম জুম্ম লিবারেশন আর্মি বা শান্তিবাহিনী, এমন কি তারা চির পরিচিত, আমাদের মাতৃভূমির মানচিত্রের এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের নামকরণ পরিবর্তন করে নাম দিয়েছে- ‘জুম্মল্যান্ড’। দেশে বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। ‘জুম্ম’ জনগনকে জোর করে মুসলিম বানানোর ভূয়া অভিযোগ রটাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মতো তারা পাহাড়ে জাতিসংঘ শান্তিবাহিনী পাঠানোর লবিং করছে। সেই সুযোগে উপজাতিদের দিয়ে পাহাড়ে গণভোট করিয়ে তাদের জুমল্যান্ড আদায় করে নিতে চায়। অথচ একটি আত্মসমর্পনকারী দলের নেতাও সদস্যদেরকে বিশ্বের কোথাও এতটা স্বাধীনতা দেয়া হয় না।

সন্তুু বাবু নিজে মন্ত্রীর সমমর্যাদায় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের পদটি আকড়ে আছেন দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি। তার জনসংহতি সমিতির নেতারা ও আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদসহ পাহাড়ের প্রতিটি অফিস আদালতে সিংহভাগ সুবিধা ভোগ করছেন। আত্মসমর্পনকারী ২০০০ শান্তিবাহিনী সদস্যকে সরকার লোভনীয় পদে চাকুরী দিয়েছেন। যারা আগরতলা/কলকাতায় শরণার্থী ছিল, সরকার তাদেরকেও পর্যাপ্ত রেশন, চাল-ডাল-তেল-টিন দিয়ে এবং চাকুরী দিয়ে পূনর্বাসন করেছেন।

তারপরও কেন এত চক্রান্ত? গত ৯ আগস্ট ২০১৪ এবং একাধিকবার সন্তুু লারমা বলেছেন- পাহাড়ে ৪২ বছর যাবতই সামরিক শাসন চলছে, উপজাতীয়দের কোন মানবাধিকার নাকি নাই? তাই যদি হত গত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে সরকারী দল আওয়ামীলীগের হাই ভোল্টেজ নেতা দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে সন্তুলারমার দলের সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদার রাঙামাটির সংসদ সদস্য কি করে হলো? তাহলে কি সন্তু বাবুরা আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর চাইতেও বেশি শক্তিশালী? অবশ্যই নয়।

বাংলাদেশ সরকারের দেয়া প্রতিটি ভূমি কমিশন কেই তারা বানচাল করে দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিক বাংলাদেশ, সন্তুু লারমারা নয়। অথচ- প্রায়ই দেখা যায়, ভূমি কমিশনের বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়েও তারা বৈঠকে আসেন না। মাঝে মাঝে দেখা যায়- তারা বৈঠককে ওয়াক আউট করে চলে আসেন। সাবেক বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী তিন পার্বত্য জেলার ভূমি কমিশনকে কার্যকরী করেছিলেন। কিন্তু, সন্তুু লারমাদের সাজেশন মতো না চলাতে তাকেও ভূমি কমিশনের আদালত/শুনানী করতে দেয়নি ঐ চক্র।

যদিও প্রায় ৫ হাজার মামলা ঐ কমিশনের কাছে উপজাতি ও বাঙালিরা দরখাস্তের মাধ্যমে জমা দিয়েছিল। একগুঁয়েমি, হামবড়া, স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের কারণে প্রতিটি পদক্ষেপই উপজাতীয় নেতারা বানচাল করে দিয়েছে। অথচ তারা কোন বিজয়ী দল নয়। একটি পরাজিত এবং আত্মসমর্পনকারী দলের কাছে এ ধরনের আচরণ মোটেও সহ্য করা যায় না। অথচ বাংলাদেশের জনগন এর পরেও তাদের কাছে শান্তির প্রত্যাশা করছেন।

পাহাড়ে এখনো প্রতিটি উন্নয়ন কাজে জেএসএস শতকরা ২০ ভাগ এবং ইউপিডিএফ শতকরা ২০ ভাগ করে বলপূর্বক চাঁদা আদায় করে থাকে। নতুবা কোন ঠিকাদার কাজে হাত দিতে পারে না। অথচ, সন্তুু বাবুরা দেশী বিদেশী মিডিয়ার কাছে বলে বেড়ায়- “শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেই নাকি পাহাড়ের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কী আজগুবি দাবী?

বিএনপি সরকারের ভূলের মাশুল দিচ্ছে পার্বত্যবাসী 
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে জেএসএস নেতা সন্তুলারমাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসের দায়ে গ্রেফতার করা হলেও শান্তি স্থাপনের শর্ত দিয়ে সন্তুুলারমাকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তুু জিয়ার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ত্রিপুরার গোপন আস্তানায় ফিরে গিয়ে সন্তুলারমা আবারো জুমল্যান্ড আদায়ের গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে? ভারতের বিএসএফ সীমান্তে হামলার জন্য শান্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাপোর্ট দিয়ে যায়। শুধু বাংলাভাষীরাই নয়, উপজাতীয় নেতা উরিমোহন ত্রিপুরা, চাবাই মগ, চুনীলাল চাকমা, বঙ্কিম দেওয়ান, শান্তিময় দেওয়ান, কিনামোহন চাকমা, রেমন্ড লুমাই, মেজর পিওরসহ অনেক উপজাতি নেতাকে বাংলাদেশের পক্ষে থাকার জন্য দুলাগোষ্টী (দালাল) আখ্যা দিয়ে তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সন্তুু লারমার নির্দেশে।

রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা ও যুব ইউনিয়ন নেতা সাংবাদিক আব্দুল রশিদ, লংগদু উপজেলার চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ সরকারসহ হাজার হাজার বাঙালি নর-নারী-শিশু-কিশোর আবাল বৃদ্ধ বণিতা পাহাড়ে খুনী শান্তিবাহিনীর ব্রাশফায়ারে এবং আগুনে পুড়ে জীবন দিয়েছেন। তাদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। ধান-ফসল-গরু-ছাগল তারা লুট করেছে। এরপরও সন্তুু বাবুরা আমাদের বীর সেনাবাহিনী, পুলিশ আনসার ও বিডিআর-দের সাথে গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত হতে বাধ্য হয়। এক এক করে তারা পালাতে শুরু করে, দল ছেড়ে সরকারের কাছে আত্মসমার্পন শুরু করে। শান্তি বাহিনীর শক্তি একেবারে শেষ হয়ে যাবার পথে এমনিতর করুণ অবস্থায়, শান্তিবাহিনীর অবস্থা যখন খুবই কাহিল, পরাজয় অবধারিত, ভারত সরকারও আশ্রয় প্রশ্রয় দিতে দ্বিধা করছিল। ঠিক তখনই বিএনপি সরকার (১৯৯১-১৯৯৫) একটি ভূল সিদ্ধান্তের কারনে সন্তুুলারমার কৌশলের কাছে হেরে যায়।

সেটা ছিল তথাকথিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি অথবা অস্ত্রবিরতি চুক্তি মেনে নেয়া। যুদ্ধবিরতি বা অস্ত্রবিরতির কথা বলে ক্ষয়িষ্ণু, প্রায় অবলুপ্ত লারমা বাহিনী দেশে বিদেশে বিএনপি সরকারের সাথে আলোচনার দাবী তুলে বেকায়দায় ফেলে দেয়। সেদিন যদি যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল অলির নির্দেশে (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান) অস্ত্রবিরতি না মেনে মুমুর্ষূ অবস্থায় লারমা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা হতো, তাহলে আর এই শান্তি চুক্তি করার দরকার হতো না।

তবে শান্তিচুক্তির পর এর বিরুদ্ধে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক লং মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পাহাড়ের প্রকৃত চিত্র পেতে বিশ্ববাসীর অনেক সুবিধা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলও পার্বত্য চট্টগ্রাম এ উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসযুদ্ধ বিষয়ে সম্যক অবগত হতে পেরেছিল সেই লংমাচ ঘোষণা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

বর্তমান সরকারের করণীয় কি?
পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত প্রেক্ষাপট বর্তমান সরকারের কাছে অনেকটা পরিস্কার হয়েগেছে। যদিও বা আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি নিয়ে আলাদা একটি ধারণা পোষণ করতো। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদিবাসী ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘে, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনি ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিদেরকে ডেকে সরকারের প্রকৃত অবস্থান প্রকাশ করেছেন। এতে করে পার্বত্যবাসী শান্তিপ্রিয় বাঙালি এবং উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বর্তমান সরকারের প্রতি বিশেষভাবে আস্থাভাজন।

তথাকথিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যদি সব বেআইনী অস্ত্র-শস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার না করা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার না করা হয় তবে জনসংহতি সমিতির এবং ইউপিডিএফএ বন্দুক যুদ্ধের মাঝখানে পরে বহু পার্বত্যবাসীকে অকালে জীবন হারাতে হবে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল কনসেপ্ট তথা পাহাড়ে ঐক্য, শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ছাড়া সন্তুলারমার হাতে সমগ্র ক্ষমতা ছেড়ে দিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদি জুম্মল্যান্ড বাস্তবায়নের রূপই পাবে বলে আমাদের গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা আছে। বর্তমান সরকার সেই সুযোগ কোন পাহাড়ী দল বা উপদলকে দিবে না বলেই দেশবাসীর একান্ত বিশ্বাস।

শান্তি চুক্তির সুফলঃ
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন।
২। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠন।
৩। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিষয় হস্তান্তর।
৪। উপজাতি শরণার্থী পুনর্বাসন।
৫। শান্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ।
৬। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার।
৭। পার্বত্য জেলা পরিষদ নামকরণ।
৮। সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে উপজাতীয়দেরকে কোটা প্রদান।
৯। উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা প্রবর্তন।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং কমিটি গঠন।
১১। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন।
১২। চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ।
১৩। ভূমি কমিশন গঠন।
১৪। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপি কর্তৃক গৃহীত শতাধিক প্রকল্প।
১৫। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ। ইত্যাদি।

অথচ এরপরও উপজাতীয় নেতাদের পাই নাই, পাই নাই ভাব কেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা তথাঃ রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সরকারি অফিস আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে শতকরা ৯০ ভাগ উপজাতি জনবল দ্বারা বেষ্টিত আছে। অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্য, সুখ ও সমৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে বাঙালিরা ক্রমান্বয়ে সমতলে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ঘরে তাদের ক্ষুধার জ্বালা, বাইরে প্রাণের ভয়। বাঙালি জনসংখ্যা পাহাড়ে বর্তমানে ৫০ ভাগ কমে গেছে। চাকুরীজীবীরাও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে মেয়াদ পূর্তির অপেক্ষায় থাকে। অথচ উপজাতীয় কর্মকর্তা, কর্মচারী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী সহ আপামর জনতা পাহাড়ে একচ্ছত্র শান্তিচুক্তির সুফল ভোগ করছেন।

ত্রিশ হাজার বাঙালি পাহাড়ে খুনী শান্তি বাহিনীর অত্যাচারে জীবন দিয়েও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর কি কোন সমাধান নেই। ২রা ডিসেম্বর এলেই পার্বত্যবাসী জনগণের মনে সেই প্রশ্ন বার বার উঁকি মারে।

লেখক: মহাসচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন(একাংশ)

Exit mobile version