শক্তিমানের শোক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো নানিয়ারচরবাসী

নিজস্ব প্রতিনিধি, রাঙামাটি:

জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা হত্যার পর সৃষ্ট নৈরাজ্য, আশঙ্কা, অনিশ্চিয়তা, টেনশন, ভয় কাটিয়ে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পাপ্ত হলো। জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করার পর শূন্য এই আসনের নির্বাচন নিয়ে অনেক শঙ্কা ও ভয় ছিলো।

কিন্তু শান্তিপূর্ণ এই নির্বাচনে জেএসএস সংস্কার আবারো ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের আসন রক্ষা করতে পেরেছে। এরফলে নানিয়ারচরে জেএসএসের অবস্থান শক্তিশালী হলো। এই নির্বাচনের মাধ্যমে নানিয়ারচরের ভোটাররা সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নানা প্রকার হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও সন্ত্রাসের হুমকি সত্ত্বেও নানিয়ারচরে জনগণ বিপুলভাবে ভোট দিয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে তারা শান্তির পক্ষে।

এই বিজয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে নতুন শক্তিতে আর্বিভূত হলো জেএসএস সংস্কার। তাদের নতুন কৌশলের কাছে নতি স্বীকার করলো ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ।

বুধবার (২৫জুলাই) অনুষ্ঠিত নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপ-নির্বাচনে জেএসএস সংস্কার সমর্থিত প্রগতি চাকমা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। জেএসএস সংস্কার এমএন লারমা গ্রুপ সমর্থিত আনারস প্রতীক নিয়ে এ প্রার্থী পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪৮৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ সমর্থিত প্রণতি চাকমা কাপ-পিরিস মার্কা নিয়ে পেয়েছেন ৮ হাজার ১৫ ভোট। ইউপিডিএফের স্বতন্ত্র(প্রক্সি) প্রার্থি কল্পনা চাকমা পেয়েছে ৪৩৬ ভোট।

জেএসএস সংস্কার এ বিজয়ের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে আরেকটি বৃহত্তর আঞ্চলিক শক্তিশালী সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করলো। এ বিজয়ের মধ্যে দিয়ে তারা একদিকে যেমন নেতা হত্যার প্রতিশোধ নিলো, তেমনি দীর্ঘদিন ধরে দখলে থাকা ইউপিডিএফ’র বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের শক্তি জানান দিলো। নেতা হত্যার শোককে তারা শক্তিতে পরিণত করেছে। শক্তিমানের জনপ্রিয়তা ও তার হত্যার পর সৃষ্ট সহানুভুতি ভোট এই নির্বাচনে সংস্কারের জয় নিশ্চিত করেছে।

এক সময় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ এবং জেএসএস সংস্কার’র মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। তাই ২০১৩ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেএসএস সংস্কার নেতা আ্যাড. শক্তিমান চাকমাকে সমর্থন দিয়েছিলো ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ । কিন্তু দল দু’টির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদা আদায়সহ নানান স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো। আধিপত্য বিস্তারে আঞ্চলিক সংগঠন দু’টি প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলো।

এছাড়া ২০১৮ সালে বছরের শুরুতে তপন জ্যোতি বর্মার নেতৃত্বে গড়ে উঠে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। আর এ সংগঠনটির সাথে সখ্য গড়ে তোলে জেএসএস সংস্কার। সংগঠন দু’টি পাহাড়ে প্রায় সময় ইউপিডিএফ’র দূর্গে হানা দিয়ে তাদের নেতা-কর্মীদের হত্যাসহ এলাকা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে আসছে এমনটা অভিযোগ ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের। তবে ইউপিডিএফ’র এমন অভিযোগ সব সময় অস্বীকার করে আসছে জেএসএস সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। তবে এ নিয়েই সংস্কার ও ইউপিডিএফের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ জেএসএস সন্তুর সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে।

তাদের এমন শক্তির মহড়ায় অবশেষে গত ৩মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেএসএস সংস্কার নেতা শক্তিমান চাকমাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ঘটনাস্থলে তার সাথে তার সংগঠনের আরেক নেতা রূপম চাকমাও গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। ৫মে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নেতা তপন জ্যোতি চাকমা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার শেষ কৃত্যে অংশ নিতে আসার সময় তার গাড়ি বহরে হামলা চালিয়ে একদল দুর্বৃত্ত তাকে গুলি করে হত্যা করে। এসময় ঘটনাস্থলে তার সাথে থাকা তার সংগঠনের তিন নেতা এবং তাদের সাথে থাকা একজন বাঙালি ড্রাইভারকেও হত্যা করা হয়।

এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জেএসএস ইউপিডিএফকে দায়ী করে আসছে। তবে এ অভিযোগ ইউপিডিএফ অস্বীকার করে আসছে। এরপর থেকে ইউপিডিএফ’র সাথে জেএসএস সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং নেতা হত্যার প্রতিশোধের শপথ গ্রহণ করে। এজন্য জেএসএস সংগঠনটি নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয় এবং নিজেদের শক্তি জানান দিতে একের পর এক ইউপিডিএফ’র দূর্গে হানা দিতে থাকে।

এবার সর্বশেষ নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপ-নির্বাচনে পুনঃরায় বিপুল ভোটের মাধ্যমে জয় লাভ করে নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হয়।

তবে এ ব্যাপারে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ’র মুখপাত্র মাইকেল চাকমা জানান, আমরা যা দেখলাম এটা কোন নির্বাচন হতে পারে না। এই নির্বাচনটা ছিলো একটি পাতানো খেলা। নির্বাচনটা ছিলো লোক দেখানো।

এক প্রশ্নের জবাবে আঞ্চলিক সংগঠনটির এ নেতা আরও জানান, এ উপজেলায় ইউপিডিএফ’র কোন প্রার্থী ছিলো না। প্রার্থী সবাই জেএসএস সংস্কার এর লোক। নিজেরা একাধিক প্রার্থী দিয়ে এখন নিজেরা বলে বেড়াচ্ছে আমাদের মনোনিত প্রার্থী নাকি হেরেছে। যা আমাদের জন্য খুবুই লজ্জাকর ব্যাপার এবং আমাদের বিরুদ্ধে একটি নিচু মনের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।

পাহাড়ি সংগঠনটির এ নেতা বলেন, ইউপিডিএফ গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে। আর নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। যতদিন নিজেদের অধিকার আদায় হবে না ততদিন ইউপিডিএফ আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে এ নেতা জানান।

নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে জেএসএস সংস্কার এমএন লারমা গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধকর ত্রিপুরার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

রাঙামাটি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার আব্দুল লতিফ শেখ জানান, শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। প্রশাসনের কড়া তৎপরতায় প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার ছিলো। যার কারণে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনের ১৪টি কেন্দ্রের সব কয়টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও প্রশাসন কর্তৃক নিরাপত্তা জোরদার থাকায় ভোটাররা আনন্দ-উল্লাসে নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পেরেছে।

রাঙামাটি পুলিশ সুপার আলমগীর কবির জানান, নির্বাচনের সময় যে কোন পরিস্থিতি মোকবেলা করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী প্রস্তুত ছিলো। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার, পুলিশ এবং র‌্যাবের সদস্যরা নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিলো।

পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও জানান, প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধি করা ছিলো। যে কারণে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

এদিকে নির্বাচনের আগে গত ১৯জুলাই (বৃহস্পতিবার) দিনগত রাতে উপজেলার সাবেক্ষ্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পাড়ার নিজ বাড়ি থেকে প্রীতিময়কে অপহরণ করে নিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। এসব ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ জেএসএস সংস্কারকে দায়ী করে আসছে। তবে এ ধরণের ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলে জানান।

এরপর ২৪ জুলাই সকাল ১০টার দিকে ছায়াধন চাকমা (৪৫) নায়িারচর বাজার করে নামের এক ব্যক্তিকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে।

তবে এ ঘটনার জন্য সংগঠনটি জেএসএস সংস্কারকে দায়ী করেছে। এ ধরণের সাথে জড়িত নয় বলে জানান জেএসএস সংস্কার।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন