রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেন মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে ভারত-চীন

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

হিমালয়ের পাদদেশে সীমান্তে বিরোধ রয়েছে চীন ও ভারতের। সিকিম নিয়ে হয়তো সারা বছরই চলে উত্তেজনা। তারপরও একটা জায়গায় উভয় দেশই সহাবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত-চীন সমর্থন দিচ্ছে মিয়ানমারকে। সহিংসতা কবলিত রাখাইনে দুই দেশেরই বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ রয়েছে। এশিয়ার দুই পরাশক্তি তাই পাশে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমার সরকারের। পশ্চিমা ও ইসলামি দেশগুলো অং সান সু চি সরকারের কাছে জবাব চাইলেও সেই পথে আগায়নি ভারত ও চীন।

২৫ আগস্ট সহিংসতার পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর নিধনযজ্ঞ শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সেই হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছে মিয়ানমার। তিনি সন্ত্রাস মোকাবিলায় সীমান্তে কঠোর অবস্থানে যেতে চান। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর পাশে থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এখনও এর কোনও জবাব দেয়নি মিয়ানমার।

ভারতেরও আশঙ্কা সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গি চলে আসতে পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থর দাবি, মিয়ানমারের আরসা, বাংলাদেশের জেএমবি ও ভারতীয় মুজাহিদিনের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। আর সবগুলোকেই সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই তৈয়বা। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে হামলার জন্য ভারত এই জঙ্গিদেরই দায়ী করে।

২৫ আগস্ট আরসার হামলার পর এক বিবৃতিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘আমরা এই সংকটের মুহূর্তে মিয়ানমারের পাশে আছি। আমরা এই সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এতে নিহত পুলিশ ও সেনাসদস্যদের ও তাদের পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করছি।’

২৫ আগস্ট থেকেই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে সেনাবাহিনী। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সহিংসতার বিষয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি ভারত। বরং তারা ভারতে থাকা রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি জানিয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ হাজার শরণার্থী জাতিসংঘের নথিভুক্ত।

চীনও রাখাইন ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মিয়ানমারে চীনা রাষ্ট্রদূত হ্যাং ল্যাং বলেন, ‘আমরা আশাকরি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি সুষ্ঠু পরিবেশ রাখবে যেন মিয়ানমার তাদের সমস্যা ভালোভাবে সমাধান করতে পারে।’

রাখাইনে বেশ বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প রয়েছে ভারত ও চীনের। ভারতের অর্থায়নে মাল্টি-মডেল প্রকল্পের আওতায় নদী ও সমুদ্রের মাঝে সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এতে করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হবে সিতে বন্দর। আর চীনের অর্থায়নের শুরু হয়েছে কিয়াক ফু বন্দর। এর মাধ্যমে তেল-গ্যাস পাইপলাইন ও রেলপথ যুক্ত হবে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে।

আর এই প্রকল্পের কোনটাই রাখাইনের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তারা যেখানে বিনিয়োগ করেছে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। তবে প্রকল্প এলাকায় সহিংসতার আশঙ্কা করছে দিল্লি ও বেইজিং।

ভারতের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক উপ-প্রধান মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিং বলেন, ‘আরসা সন্ত্রাসীরা যদি কালাদানের ভারতীয় কোনও জাহাজে হামলা করতো কিংবা ইউনান সংযোগকারী তেল-গ্যাস পাইপলাইনে হামলা করতো হবে এমন দৃশ্য সামনে আসতো না।’

ব্রিকস সম্মেলনের পার্শ্ব বৈঠকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বৈঠকে বসেন। আলোচনায় তারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে একযোগে কাজ করা ও ভুটানি সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গুরুত্ব পায় মিয়ানমারের ইস্যুও।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থনের বিষয়ে ভারতের সেন্টার ফর স্টাডিস ইন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান বিনোদা মিশরা বলেন, ‘সামরিক খাতে উন্নয়ন সহযোগিতা ও অস্ত্র বিক্রি করে মিয়ানমারে ৩০ বছর ধরে যে প্রভাব তৈরি হয়েছে চীন তা ধরে রাখতে চায়। আর ভারত সমর্থন করে তাদের প্রভাব তৈরি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে।’

মিশরা আরও বলেন, ‘ভারত ও চীন উভয়েই মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার ও সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে কারণ ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি ও চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের জন্য মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ।’

একটি শান্তিচুক্তি থাকলেও এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা চলছেই। গত মাসে নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমার সফর নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিক্রম মিশ্রী বলেছিলেন, ‘‘মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ‘অন্যদের’ চেয়ে আলাদা।’ তার এই বক্তব্য চীনকে উদ্দেশ করেই বলা হয়েছে।

মিয়ানমারের সংবাদ সংস্থা মিজিমাকে মিশ্রী বলেন, ‘ভারত মিয়ানমারের জনগণের জন্য সম্পদ তৈরি করতে চায় এবং তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করতে চায়। কিন্তু অন্যান্যরা এখানে ব্যবসায়িক সম্পদ গড়তে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কালাদানের মতো প্রকল্পতে অর্থায়ন করি। আমরা কখনই চাই না এটা মিয়ানমারের অর্থনীততে বোঝা হোক।’

মিয়ানমারের জাতীয়তবাদীরা চীনা এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করা শুরু করেছে। কিয়াক ফু গভীর সমুন্দ্র বন্দর প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ মালিকানা থাকছে চীনের কাছে। চীনের সিআিইটিআইসি গ্রুপ ৭৩০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে চীনের ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ মালিকানা নেওয়ার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমারের প্রস্তাব ছিলো দুই দেশের সমান অংশীদারিত্ব থাকবে। কিন্তু চীনা প্রতিষ্ঠান তা মেনে নেয়নি।

কিয়াক ফু চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি চীনের তেল-গ্যাস পাইপলাইনের প্রবেশপথ। এটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানির বিকল্প পথ। এই বন্দর আসলে চীনের দুটি প্রকল্পের একটি। রাখাইনে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আর এই দুই প্রকল্পেরই কাজ পেয়েছে সিআইটিআইসি। ভারতের দাবি, চীন মিয়ানমারে এইসব প্রকল্পের মাধ্যমে ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে।

ভারতীয় অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার মতো মিয়ানমারও পাহাড়সম ঋণের বোঝায় পড়বে। এটা চীনের কৌশল। তারা এই প্রকল্পের পুরোপুরি অংশীদারিত্ব নিয়ে নেবে কারণ মিয়ানমার তাদের অর্থ ফেরত দিতে পারবে না।’

মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগ জাপান থেকে আলাদা। মিয়ানমারের থিলাওয়া ও দায়েইতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ করছে জাপান। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ মিয়ানমারের হাতেই এবং ৫১ শতাংশ মালিকানা তাদের।

কিয়াক ফু ও থিলাওয়ার এই বৈষম্য তাই খুবই স্পষ্ট বলে মনে করেন সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান সাইমন তায়। তিনি বলেন, ‘দুই শতাংশ মালিকানার কম বেশি আদতে গাণিতিকভাবে খুব বেশি না হলেও বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

মিয়ানমারের রাজনীতিবিদরা চীনের সমালোচনা করেন না কারণ জাতিসংঘে তাদের সবচেয়ে বড় সমর্থন দেয় চীন। বিশেষ করে রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরও চীন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেক এনএলডি নেতা ও বিরোধী দলীয় নেতা জানান, চীনকে এত বিশাল সংখ্যক অংশীদারিত্ব ছেড়ে দেওয়া তাদের জন্য বিব্রতকর। তারাও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে এনেছেন।

চীনও কিয়াক ফুতে তাদের গ্যাসলাইন সম্প্রসারণে জাতীয়তাবাদীদের তোপের মুখে পড়েছে। চলতি বছর কিয়াক ফুর ৬০০ বাসিন্দা নৌকায় করে পেট্রোচায়নার স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়ে বিক্ষোভ করেছে। কোম্পানিটির উপস্থিতির কারণে নদীতে মাছ ধরতে পারছেন না তারা।

গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইট জানায়, ‘চীনা প্রতিষ্ঠানকে বেশি ক্ষমতা দিয়ে দেওয়ায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে স্থানীয়দের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে পারে।’ সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন