রোম্যান্টিক জুটি কি হারিয়ে গেল.?

ডেস্ক রিপোর্ট :

অতীতের দিকে তাকালে একবাক্যে সকলেই একসঙ্গে দুজনের নামই বলেন যেমন রাজকাপুর-নার্গিস, দিলীপ কুমার-সায়রা বানু, উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম কুমার-মালা সিনহা, রহমান-শবনম, জেবা-মোহাম্মদ আলী, জেবা-ওয়াহিদ মুরাদ, রাজ্জাক-কবরী, রাজ্জাক-শাবানা, সালমান শাহ-মৌসুমী। তারপর শাকিব-অপু বিশ্বাস। এটাই সম্ভবত ঢাকার শেষ সফল পর্দা জুটি। মাঝখানে রিয়াজ-শাবনুর বা মান্না-মৌসুমী একত্রে অনেক ছবিতে অভিনয় করলেও স্থায়ী জুটি ইমেইজ তৈরি করতে পারেননি। আসলে তাদের সময় থেকেই জুটি বিষয়টি দর্শকদের কাছে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। আর হলিউডে সোফিয়া লরেন-মার্সেল্লো মাস্ত্রয়্যান্নী, এলিজাবেথ টেইলর-রিচার্ড বার্টন বা টনি কার্টিস-নাটালি উড দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাপী সিনেমা দর্শকদের আবিষ্ট রেখেছিলেন যৌথ ইমেইজে। সেটাও ঐ সত্তর দশক পর্যন্ত।

মুম্বাইতেও এখন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বা দীপিকা পাড়ুকোন কিংবা সোনম কাপুর একক পরিচয়েই সিদ্ধ। রণবীরের সঙ্গে অভিনয় করলেও রণবীরের সঙ্গে কোনো যৌথ ইমেইজ গড়ে ওঠেনি। রণবীরও একক পরিচয়ে জনপ্রিয়। আশির দশকে সেখানে আমির খান-জুহি চাওলা এক ছবিতেই বাজিমাৎ করে জনপ্রিয় জুটি হলেও তারা আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি ব্যক্তিগত কারণে। আমির খান পরে অনেকের সঙ্গে রোম্যান্টিক পর্দা-সঙ্গী হয়েছেন কিন্তু কারো সঙ্গে আর জুটি হয়নি। ‘লগন’ ‘তারে জমিন পর’ ‘আতঙ্ক হি আতঙ্ক’ ‘দঙ্গল’ ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ সবখানে একই কথা খাটে, ঐ একক বিস্তার।

রোম্যান্টিক জুটির ধারণা আসলে কারো পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়নি। দর্শকরাই এ প্রথাটিকে ভিত্তি দিয়েছেন। নির্মাতারা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা অনুসরণ করেছেন। চলচ্চিত্রে রাজকাপুর-নার্গিস, দিলীপ কুমার-সায়রা বানু বা উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্টিক ছবিগুলো দর্শকপ্রিয়তা পেলে সেই পঞ্চাশ ষাট দশকে নির্মাতারা তাদের নিয়েই একের পর এক নতুন নতুন গল্প ফেঁদে ছবি মুক্তি দিতে থাকেন। এভাবেই পত্তন হয় জুটির। এর পেছনে একটা ব্যবসায়িক বুদ্ধিবৃত্তিও কাজ করেছে। এদের একসাথে পর্দায় উপস্থিতির ছবি ভালো ব্যবসা করেছে বলে তাদের জুটিবদ্ধ করেই তৈরি হয়েছে একর পর এক চলচ্চিত্র। উত্তম কুমারের সঙ্গে সাবিত্রী চ্যাটার্জি বা কাবেরি বসুকেও যুক্ত করা হয়েছিল। খুব একটা কাজ হয়নি। সুপ্রিয়া দেবী ব্যক্তিজীবনে উত্তম কুমারের ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’র ভূমিকা পালন করলেও তার সঙ্গে উত্তম কুমারকে কখনো রোম্যান্টিক জুটি হিসেবে কল্পনা করেননি দর্শক।

ঢাকার ছবির সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকজন পুরুষ তারকার নাম বলা যাক। চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান। এদের কারো সঙ্গেই নির্দিষ্ট কোনো নারী তারকার নাম যুক্ত করে দর্শক দেখেন না। কয়েকজন নারী তারকার নাম বলি- জয়া আহসান, মাহিয়া মাহি, বিদ্যা সিনহা মিম, পরীমণি, বুবলি। এরা কারো সঙ্গেই চলচ্চিত্রিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি যার পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায় অমুক নায়কের সঙ্গে তার একটা পর্দা-বাঁধন আছে। জয়া আহসান নিজে এমন একটা ইমেইজ তৈরি করেছেন যে, তাকে আলাদা ব্যক্তিত্ত্ব হিসেবেই দেখেন দর্শকরা। কারো সঙ্গে মিলিয়ে একত্রে দেখেন না। অন্যদের ব্যক্তি ইমেইজই গড়ে ওঠেনি এখনও।

এখনকার তারকারা নির্দিষ্ট চরিত্রে ভালো করেন। ভিন্নতায় গেলে তাল লয় ঠিক রাখতে পারেন না। অনেকে ভালো অভিনয় করেন কিন্তু ভার্সেটাইল নন। সেকারণে প্রভাব সৃষ্টিকারী নায়ক বা নায়িকার আসনটি গড়তে পারছেন না। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকেই পর্দা-জগতে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। এদের কোনো দুজনের নাম জুড়ে ‘রোম্যান্টিক জুটি’ বললেও দর্শক তাদের আলাদা করেই ভাবেন। দুজনের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্ক যুক্ত করার উপাদানও ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায় না।

এখন আসলে এককের যুগ। ব্যক্তি নিজেই একশ। জুটির দিন তাই বলা যায় শেষ। গত শতাব্দীর প্রায় শেষ দিক থেকে ছবির কাহিনিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রেমের কাহিনি নিয়ে নায়ক-নায়িকার যৌথ আবেগ তৈরির বদলে একক ব্যক্তির ভূমিকা এখন প্রধান। ঢাকায় ফারহানা মিলি ও চঞ্চল চৌধুরীর একটি রোম্যান্টিক ছবি বড় ধরনের আর্থিক সাফল্য পেলেও তাদের কারো সেভাবে রোম্যান্টিক ইমেইজ গড়ে ওঠেনি। তাই দর্শকের কাছে তারা ঐ ছবির বাইরে আর জুটি নন। মুম্বাইয়ের হালের ‘বাহুবলি’ প্রেমের কাহিনি হলেও সেখানে নায়িকার কোনো প্রভাব তৈরির সুযোগ নেই। যা করেন ঐ নায়কই। তাই এখানে তাদের জুটি করে কেউ দেখে না। নায়কের বাহাদুরি বা ত্যাগই যেন প্রধান উপাদান।

২০১৮ সালে ঢাকায় চারজনকে চিহ্নিত করা হচ্ছে নতুন বছরের ‘নায়ক’ হিসেবে। শাকিব খান, আরিফিন শুভ, সাইমন সাদিক, বাপ্পি চৌধুরী। এদের মাঝে শাকিব আর শুভ ছাড়া অন্যদের কোনো রোম্যান্টিক ইমেইজ দর্শকদের কাছে আছে বলে মনে হয় না। আবার শাকিব ছাড়া অন্যদের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট নারী তারকার যুক্ত-ইমেইজ নেই। তাদের পরে নবাগত তরুণ কয়েকজনের দিকে তাকালেও একই অবস্থা। মেহজাবীন চৌধুরী, ঐশী, বুবলী, তাসকিন আহমেদ, মিনার রহমান, জায়েদ খান। এদের মাঝে কেবল বুবলি আলোচনায় আছেন ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাবলিতে। শাকিব অপুর সাংসারিক সংকটে তৃতীয় ব্যক্তি হওয়ার কারেণে তার সঙ্গে শাকিবের পর্দা জুটি খুব একটা জুৎসই হবে বলে মনে হয় না। ওদের পর্দায় দেখলেই দীর্ঘদিন দর্শকদের হৃদয়ে খচখচ করবে অপুর স্মৃতি। বুবলিকে কেউ কেউ দায়ী করবেন ব্যক্তি জীবনে অপু-শাকিবের ঘর ভাঙার মূল ‘ভিলেন’ হিসেবে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাধারণ মানুষ, যারা মূলত সিনেমার প্রধান দর্শক, এখনও স্বপ্নের দেবীকে দেখতে চান একেবারে নির্মল চরিত্রের মানবী রূপে।

জুটির যুগের সঙ্গে এখনকার একটা বড় তফাৎ হলো কাহিনির ধারা। পঞ্চাশ দশক থেকে গত শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত ছবির কাহিনিতে সমান গুরুত্ব পেয়েছেন নায়ক-নায়িকা। উত্তম-সুচিত্রা বা রাজ্জাক-শাবানা প্রতিটি ছবিতেই প্রায় সমান সমান গুরুত্ব পেয়েছেন। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে কল্পনা করতে পারেননি দর্শক। এখন গুরুত্ব পায় একজন। নায়ক নতুবা নায়িকা। এককভাবে নায়ক নায়িকাদের পর্দায় দেব-দেবীর ইমেইজ নিয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকাও প্রায় দুঃসাধ্য। আবার এটাও বাস্তব যে, নবাগতদের ঢল অল্পদিনের মধ্যেই একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। কিন্তু কেউ দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারেন না প্রভাব নিয়ে। আশির দশক পর্যন্ত যোগ্য নবাগত নায়িকার আগমন ছিল সীমিত। পুরনোরা তাই টিকে যেতেন দীর্ঘদিন। মুম্বাইয়ের ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী বা শ্রীদেবী-জিতেন্দ্র জুটি এর একটা বড় দৃষ্টান্ত। ঢাকায় রাজ্জাক-শাবানার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। রাজ্জাক ছাড়া শাবানা কিংবা শাবানা ছাড়া রাজ্জাক ছিলেন যেন অসম্পূর্ণ এক আইডল।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *