যেভাবে দিন কাটছে রুমার সীমান্তের বৌদ্ধ শরণার্থীদের
রুমা প্রতিনিধি, সীমান্ত থেকে ফিরে:
বান্দরবানের রুমায় রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে চইক্ষ্যং পাড়ার সীমান্ত রেখায় অবস্থান করছে ৩৮ পরিবারের শরণার্থী সদস্যরা। কাতরাচ্ছে- প্রচণ্ড শীতে। তারা সবাই মায়ানমারের কাচিন স্টেটের বাসিন্দা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সীমান্ত পেরিয়ে এপারে চইক্ষ্যং পাড়ায় অনুপ্রবেশ করেছে তারা।
তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে চইক্ষ্যং পাড়ায় রয়েছেন বিজিবি’র একটি দল। সীমান্ত রেখা থেকে শরণার্থীরা স্বেচ্ছায় চলে যাবে এবং আর কোনো শরণার্থী অনুপ্রবেশের সুযোগ পাবে না সে ব্যাপারে নজর রাখার কথা জানালেন সেখানকার বিজিবি কর্মকর্তা।
এক সপ্তাহ’র বেশি ধরে থাকা এসব শরণার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও খাদ্য সংকট। অচিরেই খাদ্য সমস্যায় পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে স্থানীয় পাড়াবাসীর মধ্যেও।
এ প্রতিবেদক সরেজমিনে গিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল ২.২০ মিনিটে চইক্ষ্য পাড়ায় পৌঁছেন । পাড়ায় প্রবেশ করেই দেখতে পান দুইজন ছেলে খেলছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি। কাছে গিয়ে তাদের ভাষায়- আকো- এ রোয়া সা বা ল? ( আপনি এ পাড়ার কিনা) এমন প্রশ্নে উত্তর মিলে, হুফাক্কা বা অর্থাৎ ওপার থেকে।
এর নাম রেদাকশে(৩৫), তিন ছেলেসহ স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবারে মোট সদস্য পাঁচজন। তার বাড়ি খামংওয়া রোয়া, পালেটওয়া জেলা, চিন স্টেট, মায়ানমার। সে জানায়, ৪ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে এ পাড়ায় এসেছে।
কতজন এসেছে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, ১৫০ থেকে ১৬০ জন হতে পারে। কাংতালাং ও খামংওয়াসহ ছয়-সাতটি পাড়া থেকে প্রায় সবাই পালিয়ে গেছে।
তবে শুধুমাত্র আমরা (রাখাইন) নয়। খ্যও এবং খুমি সম্প্রদায়ের লোকজনও আছে। এসময় গলায় লুঙ্গি ঝুলিয়ে আরেকজন এগিয়ে আসে। নাম মংশে। এটা তার ডাকনাম। আসল নাম বলেনি।। তার বয়স (৩৭), সেও খামংওয়া পাড়া থেকে এসেছে।
এপারে কেন এলেন এবং কিভাবে এসেছেন তা নিয়েও কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে।
রেদাকশে জানায়, দুর্গম পাহাড়ি পথে থেমে থেমে পায়ে হেঁটে খামংওয়া পাড়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে চইক্ষ্য পাড়ায় এসে পৌঁছতে দুইদিন এক বেলা সময় লেগেছিল। অন্যান্য পাড়ার লোকজনদের পথে মধ্যে দেখা হয়ে এক সাথে মিলিত হয়।
আরেক প্রশ্নে উত্তর সরাসরি দেয়নি তারা। বলেছে, আমাদের সেখানে থাকা অনিরাপদ, তাই তারা (আরাকান আর্মী-এএ) রাস্তা চিনিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
কেন এসেছে এই প্রশ্নে রেদাকশে আরো জানায়, মায়ানমার আর্মিদের সাথে আমাদের এএ (আরাকান আর্মি) প্রায় সময় গোলাগুলি হয়। তার মধ্যে জানুয়ারি শেষ সপ্তাহ তাদের পাড়া থেকে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা পথ, এক পাড়ায় হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণ করে মায়ানমার আর্মি। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে অন্যান্য পাড়াতেও বোমা বর্ষণ করতে পারে, এ আশঙ্কায় তারা সীমান্ত পেরিয়ে এপারে চইক্ষ্যং পাড়ায় ঢুকে পড়েছে। এমনটি জানিয়েছে চইক্ষ্যং পাড়ায় অবস্থান করা বৌদ্ধ শরণার্থীরা।
ফিরে চলে যাবেন কিনা, এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়নি। তারা জানায়, ওখানে বেশি গোলাগুলি চলছে। ফিরে গেলে হয় মায়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে রাষ্ট্রদ্রোহী কেসে জেল খাটতে হবে, না হয় গোলাগুলি মধ্যে অবস্থা খারাপ হবে আমাদের। এখানে হলে আমার পরিবার নিরাপদ হবে। তবে খাবার নিয়ে চিন্তিত তারা।
কারা খাবার দিচ্ছে এখন প্রশ্ন করলে সে জানায়, পাড়ার লোকজন।
তবে পাড়াবাসীরা বলেছে, এখানে এমনিতে খাবার সংকট, তারপরও মানবিক কারণে তাদের খাওয়াচ্ছেন। এভাবে আর কতদিন খাওয়াতে পারবো জানিনা।
বৌদ্ধ শরণার্থীরা প্রথমে মাঠে অবস্থান করলেও শীতে কষ্ট ও মানবিক কারণে তিন চারটি টংঘর খালি করে সেখানে তাদের থাকতে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে না হলেও পাড়াবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।
তবে শরণার্থীরা এখন তরকারি হিসেবে কলার থোর ও পাহাড়ী আলু সংগ্রহ করে খাচ্ছে।
স্থানীয় সাবেক মেম্বার রামতন বম জানান, শরণার্থীরা আসার পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি এক মায়ের বাচ্চা প্রসবে যন্ত্রণা শুরু হয়। তাকে একটি বাসায় পাঠিয়ে প্রসব করানো হয়। আরো আছে তিন গর্ভবতী মা। এসব শরণার্থীদের গায়ে লুঙ্গি ও শার্ট ছাড়া আর কিছু নেই অনেকের।
তবে চইক্ষ্যং পাড়া ঢুকে পড়া শরণার্থীদের সংখ্যার তথ্য গড়মিল দেখা দিয়েছে। সীমান্তে অবস্থানরত বিজিবি’র তথ্য মতে, শরণার্থিদের সংখ্যা ৩৮ পরিবারের ১৩৬জন।
কিন্তু পাড়াবাসীর গণনা মতে, মোট- ৩৮ পরিবারের ১৬০জন। তার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৫৯ জন।
সম্প্রদায় ভিত্তিক তাদের হিসাবে রাখাইন ২৩ পরিবার, পুরষ-৩৩ জন, নারী-৩৫ জন ও শিশু-২৩জন, মোট ৯১জন।
খুমি- ৯পরিবার, মোট-৩৫জন। তার মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী- ৯জন, পুুরুষ-৭জন ও শিশু- ১৯জন।
খ্যও সম্প্রদায়ের ৬পরিবার। জনসংখ্যা মোট-৩৪জন। নারী- ৬জন, পুরুষ- ৮, শিশু-২০জন।
আর শরণার্থীদের হিসাব মতে, সব মিলে ২০৫ জন। তবে পরিবার ও নামের পরো তালিকা কোনো পক্ষের কাছে পাওয়া যায়নি। ফলে শরণার্থীদর সংখ্যা নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
এদিকে রোববার জেলা প্রশাসক কার্যলয়ে বান্দরবান জেলা আইন শৃঙ্খলা ও মাসিক উন্নয়ন সভায় পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রী সতর্ক বলেছেন, পার্বত্য এলাকায় কোনো শরণার্থী আশ্রয় নিতে পারেবেনা, কেউ তাদের আশ্রয় দিয়ে নিজকে বিপদ ডেকে না আনতে সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশেসিং এমপি।
প্রসঙ্গত; মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে রাখাইন রাজ্যের মুসলমানরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এ পর্যন্ত সাত লাখের বেশি মুসলমান এখানে আশ্রয় নিয়েছে।