দেশ জয় করলেন পাহাড়ের মেয়ে মেলিনা ত্রিপুরা

14

সাইফুর রহমান :

প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীর হত-দরিদ্র পরিবারের মেয়ে মেলিনা ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি নবসৃষ্ট গুইমারা উপজেলার হিরেন্দ্র কার্বারিপাড়ার দিনমুজুর পিতার দরিদ্র সংসারে জন্ম তার। সংসারের বড় মেয়ে মেলিনাকে ছোট বেলা থেকে পড়াশোনার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। পাহাড়িয়া পথ বেয়ে প্রায় ৭ কিঃ মিঃ রাস্তা পায়ে হেটে স্কুলে আসতে হতো তাকে।

৪ ভাই-বোনকে নিয়ে দরিদ্র পিতার অভাব অনটনের সংসারে শত কষ্টের মাঝেও টিওশনি করে অব্যাহত রাখে নিজের পড়াশোনা। ২০১৫ সালে গুইমারা মডেল উচ্চ বিদ্যলয় থেকে ৪.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় মেলিনা। শিক্ষা স্বপ্নের প্রথম ধাপ পেরিয়ে ২০১৫/১৬ শিক্ষাবর্ষে গুইমারা কলেজের প্রথম ব্যচে ভর্তি হয় মেলিনা। শুরু হয় শিক্ষা যুদ্ধের ২য় অধ্যায়।

গুইমারা কলেজের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা ২৪ আটিলারী ব্রিগেডের, সাবেক গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তোফায়েল আহমেদ প্রত্যন্ত পল্লীর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে নানা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনা মূল্যে শিক্ষা উপকরণ (বই, খাতা), কলেজ ইউনিফর্ম তুলে দেন রিজিয়ন কমান্ডার। এরপর মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করেন শিক্ষা বৃত্তি। শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের জন্য গঠন করেন চারটি হাউজ ও ১০ ক্লাব। তারমধ্যে সমাজ কল্যাণ ক্লাব ইতোমধ্যেই সামজিক উন্নয়নে নানা সচেতনতা মূলক কার্যক্রমের মাধ্যমের স্থানীয়দের নজর কেড়েছে।

14468463_1259811404037849_4493346693989626781_o

শুধু তাই নয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তোফায়েল আহমেদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় ৪ মাসের মাথায় গুইমারা কলেজ পাঠদানের স্বীকৃতি পায়। যা শিক্ষার্থীদের বাড়তি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি গুইমারা কলেজ’কে। সরকারী-বেসরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বেশ ক’জন মন্ত্রী-এমপিসহ অনেকের পদার্পন ঘটে এ কলেজে।

এদিকে বছর না ঘুরতেই কলেজটি জাতীয়করণের ঘোষণা আসে। এতে করে কলেজের পরিচালনা পর্ষদ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীর মধ্যে নব প্রাণের সঞ্চার হয়। শিক্ষকদের বিরামহীন প্রচেষ্টায় নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বি হওয়ার অনুপ্রেরণায় একাধিক শিক্ষার্থী স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক আয়োজিত “নদী ও পর্যটন” বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জাতীয়ভাবে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাহ-জাহান খান (এমপি)’র হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন মেলিনা ত্রিপুরা। মেলিনার এই অর্জনে তার কলেজ, গুইমারা উপজেলাবাসী, খাগড়াছড়ি জেলাবাসী ও তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ গর্বিত।

মেলিনা জানান, জাতীয়ভাবে দ্বিতীয় স্থান লাভ করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত, তবে আমার পেছনে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন আমার মা বাবা ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলী। ভবিষ্যতে কি হতে চায়, এমন প্রশ্নের জবাবে মেলিনা বলেন, আমি ডাক্তার হয়ে পাহাড়ী জনপদের হত-দরিদ্র মানুষের সেবা করতে চাই, তবে আমার দরিদ্র পিতার পক্ষে আমাকে সহায়তা করা অনেকটা কঠিন। তবে এ পথ যতই কঠিন হোক না কেন হাল ছাড়তে রাজি নয় মেলিনা।

গুইমারা কলেজের অধ্যক্ষ মো. নাজিম উদ্দিন জানান, মেলিনার লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ। মেয়েটি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে, আশা করি সে অনেক দুর এগিয়ে যাবে।

কলেজ নির্বাহী কমিটির সভাপতি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী ইংরেজ কবি টমাস গ্রে’র একটি কবিতার উক্তি স্বরণ করে বলেন, “জঙ্গলে অনেক ফুল ফোটে, কিন্তু তার সুবাস লোকালয়ে পৌঁছানোর পূর্বে ঝরে যায়, তবে আমরা তাকে সাহায্য করবো”।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: গুইমারা, ত্রিপুরা, পুরস্কার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন