মানবাধিকার কমিশন কাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে চলেছে
আবু উবায়দা:
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে আমাদের দেশে। সেই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব হলো দেশের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে সেখানেই ছায়া হয়ে ভোক্তাভূগীর পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু কি করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন? এই প্রশ্নটি মানবাধিকার কমিশনকে রেখে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।
বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অঞ্চল যেখানে সারা দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বিচার বহির্ভূত অপরাধ সংগঠিত হয়। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের নিত্য অপকর্মে এখানকার জনজীবন অসহায়। সুতরাং এই অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে থাকাটা অবশ্যই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু কী করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন?
পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন উপজাতীয় সন্ত্রাসী নিহত হলে কিংবা সন্ত্রাসীদের গায়ে সেনাবাহিনীর নামে কোন আঁচড় লাগলে প্রায়ই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পাহাড়ে সাধারণ কোন নাগরিক যখন উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে জীবন দেয় তখন তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
সম্ভবতঃ পাহাড়ে কোন সাধারণ নাগরিকের পক্ষে কাজ করা মানবাধিকার কমিশনের সংবিধানে নেই।
উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নানিয়ারচর উপজেলায় মৃত ছাদিকুল হত্যায় মানবাধিকার কমিশন কিছু না বললেও উপজাতীয় সন্ত্রাসী রোমেল হত্যায় তারা একেবারে আদাজল খেয়ে নেমেছেন।
দুর্ভাগ্য ছাদিকুলদের আর সৌভাগ্য রোমেলদের। ছাদিকুল পাহাড়ের সাধারণ মোটরসাইকেল চালক আর রোমেল বাংলাদেশ বিরোধী উপজাতীয় সংগঠন ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা। রোমেল যদি রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠনের নেতা না হয়ে সাধারণ উপজাতি হতেন তবে কি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মায়া কান্না দেখাতেন? নিশ্চই দেখাতেন না।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠনের প্রকাশ্য অস্তিত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান। উপজাতীয় তিন সশস্ত্র রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনের অত্যাচারে দেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকে। এমন কোন দিন নেই যে উপজাতীয় সসস্ত্র সংগঠন দ্বারা পাহাড়ের সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে না। কিন্তু এই নির্যাতিত সাধারণ মানুষগুলোর পাশে কেউ নেই। মানবাধিকার কমিশনের চোখে এসব কখনো আসেনা।
১৯৮৫ সালে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর গেরিলা জীবন হতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য কিনা মোহন চাকমা। কিন্তু এটা অপরাধ ছিলো তার ওদের দৃষ্টিতে। ১ ডিসেম্বর, ২০০৬ সালে উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএস রাঙ্গামাটির জুড়াছড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো তাকে। যেই মৃত দেহের ছবি একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে দেখাটাও হৃদয় বিদারক। এতে বোঝা যায়, কতটুকু নির্মম ছিলো কিনা মোহন হত্যাকান্ড। কিন্তু, তার বিচার কি হয়েছে?
গত বছরের ঘটনা। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মুকুল চাকমাকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। কি অপরাধ ছিলো চাকরি হতে অবসর নেওয়া এই ব্যক্তির? অথচ, আমরা দেখেছি মুকুল চাকমা অপহরণ ঘটনায় প্রশাসনকে উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা ও বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমাকে গ্রেফতার করতে।
এই বড়ঋষি শুধু মুকুল চাকমা নয়, তার অত্যাচারে সমগ্র বাঘাইছড়ি উপজেলায় বোবা কান্না বিরাজমান। অথচ গ্রেফতার হওয়ার পর কতো সহজেই না মুক্ত হয়ে গিয়েছিলো তিনি। সার্জেন্ট মুকুলের পরিবারের কান্না এবং পিতা হত্যার বিচারে আকুলতায় নমিশা চাকমার আর্তি কিন্তু আমাদের মানবাধিকার কমিশনের কর্মীদের দৃষ্টি আসেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে কোন বাঙ্গালীর মৃত্যু হলে তার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে যেখানে সারা দেশের সুশীল, বুদ্ধিজীবী বিমুখ, সেখানে পার্বত্য বাঙ্গালী হত্যা বিষয়ে আমি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টিতে না আসাকে অস্বাভাবিক কিছু বলবো না। বরঞ্চ বলবো এটা পার্বত্য বাঙ্গালীদের জন্য বিধাতার লেখা নিয়তি। কিন্তু কিনা মোহন, মুকুলদের কি দোষ ছিলো? তারাতো পার্বত্য বাঙ্গালী নন। কেন তাদের হত্যার তদন্তে মানবাধিকার কমিশনের সুদৃষ্টিপাত হয়নি?
এবার আসুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বাস্তব কর্ম পরিকল্পনায়। সারা দেশের হত্যাকাণ্ড, গুম, ক্রসফায়ার বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, যেখানে সেনাবাহিনী শব্দটির গন্ধ আছে সেখানেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন উপস্থিত। অর্থাৎ যেনো সারাদেশে সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কেউ দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে না। তনু হত্যায় মানবাধিকার হাজির হলেও ছাত্রদল নেতা নুরু হত্যায় মানবাধিকার বিদেশে বেড়াতে যায়।
অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন সেনাবাহিনীর সাথে বন্ধুক যুদ্ধে কোন উপজাতীয় সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয় তখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে পাহাড়ের সাধারন মানুষ নিহত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়না। এদিকে পাহাড়ে সেনা সদস্য হত্যাতো কোন অধিকারের পর্যায়েই আসেনা।
একটু খেয়াল করুন যারা ছাত্র রোমেল চাকমাকে সন্ত্রাসী বানালো, যারা রোমেলের হাতে কলমের বদলে অস্ত্র আর খাতার বদলে চাঁদার রশিদ তুলে দিলো তারা দোষী নয়। পার্বত্য নিরীহ জনমনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সন্ত্রাস দমন করতে গিয়ে দোষী হলো সেনাবাহিনী।
শুধু পাহাড়ে নয়, সমতলেও সারাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য খুন, গুম, ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে। তাদের মধ্যে অনেক ঘটনা ব্যাপকভাবেও আলোচিতও হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনকে সেসব নিয়ে তদন্ত করতে দেখা যায় না, সেসব নিয়ে সচল হতে দেখা যায় নি। কিন্তু মানবাধিকার কমিশন সচল হয়েছে কল্পনা চাকমা ইস্যু নিয়ে, তনু ইস্যু নিয়ে, রোমেল চাকমা ইস্যু নিয়ে- যার প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নাম কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে ছিল। মানবাধিকার কমিশনের এই সেনা স্পর্শকাতরতার কারণ কি হতে পারে তার উত্তর জাতি দেবে হয়তো একদিন।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বরাবরই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একপেশে কাজ করে যাচ্ছে। যা সাধারন মানুষের জন্য নয়, উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের জন্য। শুধু উপজাতীয় সন্ত্রাসী নয়, যারা রাষ্ট্রদ্রোহী এবং স্বাধীন বাংলার একটি অংশকে আলাদা নতুন রাষ্ট্র জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের জন্য। সুতরাং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নামক প্রতিষ্টানটি বস্তুতঃ মানবাধিকার আদায়ে সাধারন মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত কোন প্রতিষ্ঠান নয়। এটা বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সন্ত্রাস বান্ধব একটি প্রতিষ্ঠান এটাই এখন প্রমানিত।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।
মুক্তমতে প্রকাশিত সকল লেখকই পাঠকের নিজস্ব মতামত। পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।