ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনীতে বাঙালি উচ্ছেদের শঙ্কা : উত্তপ্ত পার্বত্যাঞ্চল

পাহাড়ে অশান্তির আগুন- শেষ

ভূমি কমিশন

ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে :
অবৈধ অস্ত্র, চাঁদাবাজীসহ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতায় অস্থিরতা লেগেই থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এরই মধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ সংশোধনী নিয়ে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ওই এলাকা। সংশোধনী আইনকে উপজাতি নেতারা স্বাগত জানালেও বাঙালিরা একে বাঙালি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।

উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে জাতিগত বিদ্বেষ। যে কোন সময় ঘটতে পারে অপ্রীতিকর ঘটনাও। এই আইনের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, পার্বত্য চট্টগ্রামের অখ-তা, সরকারের মর্যাদা, কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। যদিও পার্বত্য অঞ্চলের মূল সমস্যা হিসেবে ভূমিকেই সকলে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু দেশের এক-দশমাংশ এলাকায় কখনই ভূমির ক্যাডেস্টাল সার্ভে (সিএস) না হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ভূমির এই সমস্যা সমাধানের জন্য বর্তমান সরকার ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী এনেছে। এই কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এই সংশোধনী নিয়েই পাহাড়ে শুরু হয়েছে আন্দোলন। উত্তাল হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।

জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির ৪, ৫ ও ৬ ধারা মোতাবেক ২০০১ সালের ১৭ জুলাই জাতীয় সংসদে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস হয়। এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই মন্ত্রিসভায় এই আইনের সংশোধনী গেজেট আকারে পাস হয়ে গত ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস হয়।

নতুন আইনে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এই কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ বা তার মনোনীত প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান বা তার প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার/অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। এতে সার্কেল চিফ বা তার প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদ বা তার প্রতিনিধি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা উপজাতীয় সদস্য হবে। চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিব সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বাঙালি বা পাহাড়ি যে কেউ হতে পারে। কিন্তু পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি সেখানে রাখা হয়নি।

ভূমি-কমিশন-আইন

এছাড়াও কমিশনের বিচারিক আইনে উপজাতীয়দের সামাজিক আইন প্রথা, রীতি ও পদ্ধতিকে নির্ধারণ করায় তা বাঙালিদের বিরুদ্ধে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বিশেষ করে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সরকার খাস জমিতে পুনর্বাসন করায় সেখানে উপজাতীয় সামাজিক আইন গণ্য করা হয়নি। এতে বাঙালিদের পক্ষে এই কমিশনে সঠিক বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে তাদের দাবি। অন্যদিকে কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ না থাকায় বাঙালিরা কমিশনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন।

এর আগে ২০০৯ সালে পার্বত্য জেলার ভূমি ব্যবস্থাপনা, জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনে কমিশনের উপস্থাপিত বা দাখিলকৃত তথ্য উপাত্ত প্রচলিত আইন বিবেচনায় পার্বত্য জেলাধীন পাহাড় এবং জলেভাসা জমিসহ সমূদয় ভূমি (প্রযোজ্য আইনের অধীন অধিগ্রহণকৃত এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমি ব্যতীত) মৌজা ওয়ারী স্থানীয় জরিপ কার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

ওই সময় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে সার্কেল চীফ ও আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিনিধি কমিশন সভা বর্জন করার পাশাপাশি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ থেকে প্রথমে ২৩ দফা পরে ১৩ দফা সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়। পাহাড়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার কমিশন আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে নতুন কমিশন গঠন করে।

ভূমি কমিশনের সংশোধনী সম্পর্কে বাঙালি সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, সংসদে উত্থাপিত বিলে আইনের ৬(গ) ধারায় ভূমির পরিবর্তে ‘যে কোন ভূমি শব্দগুলো জুড়ে দেয়ায় তিন পার্বত্য অঞ্চলের যে কোন ভূমি/জমি পাহাড়ীরা নিজের দাবি করে ভূমি কমিশনে আবেদন করতে পারবেন।

এরপর কমিশন বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দাবি করা ভূমি উপজাতিদের নামে নাম জারি করতে পারবে। এতে একদিকে সরকারের এখতিয়ার যেমন খর্ব হবে তেমনি তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিরাও ভূমিহীন হতে বাধ্য হবে।

পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ‘ঘ’ অনুচ্ছেদের ৪-এ বলা হয়েছে ‘গঠিত ভূমি কমিশন পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জায়গা-জমির বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করাসহ এ যাবত যে সকল ভূমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে, সেসব জমি ও পাহাড়ের মালিকানার স্বত্ব বাতিলে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

তারা বলেন, মন্ত্রিসভায় যে ৬টি সংশোধনী প্রস্তাবকে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেটি সম্পর্কে পাহাড়ী-বাঙালি কারোরই ধারণা নেই। বাঙালিদের সংগঠনগুলো পাহাড়ীদের রীতিনীতি এবং পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমি কমিশন কাজ করলে ভিটে মাটি হারা হবে এমন আতঙ্কে আছে।

পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনের পর উপজাতি জনগোষ্ঠি এটিকে স্বাগত জানালেও আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন বাঙালিরা। পার্বত্য অঞ্চল থেকে বাঙালি উচ্ছেদের অংশ হিসেবেই এই আইনকে তারা বিবেচনা করছেন। এই সংশোধনী বাতিলের দাবিতে ইতোমধ্যে পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে পাহাড়ের বাঙালি সংগঠনগুলো।

এমনকি খাগড়াছড়িতে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণাও করেছে তারা। যদিও চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ইতোমধ্যে বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকের সভাপতিত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), রাঙামাটির চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ সাচিং প্রু চৌধুরী ও বান্দরবানের বোমাং সার্কেল উ ছ প্রু চৌধুরী, রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যা শৈ হ্লা, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মমিনুর রশিদ আমিন ও কমিশনের সচিব রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহীম বীর প্রতীক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন পক্ষের ব্যক্তিগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ বিরাজমান। এইরূপ দ্বন্দ্ব বা বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারি ব্যবস্থা কাম্য। কিন্তু দুঃখজনক ও আতংকজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার নিমিত্তে যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করেছে, সেই আইনের অনেকগুলো বিধান এবং সেই বিধানের বাস্তবায়নকে আমি বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করি।

পার্বত্য সমঅধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক এমপি ও উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভুঁইয়া ভূমি কমিশন আইনকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বিরোধী আখ্যা দিয়ে বলেন, এই আইনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব, অখ-তা, সরকারের মর্যাদা, কর্তৃত্ব ও অধিকার খর্ব হবে। তিনি বলেন, বর্তমান আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের সামাজিক আইন যাকে আইনে প্রচলিত রীতি ও পদ্ধতি বলা হয়েছে সে আইনে অধিগ্রহণ ব্যতিরেকে সকল ভূমি বন্দোবস্তী অবৈধ হয়ে যাবে।

অর্থাৎ এখন যেখানে ডিসি অফিস, এসপি অফিস বা অন্যান্য সরকারী অফিস রয়েছে তাতে যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো অধিবাসী যদি বলে এই জমিতে তার দাদার বাবা গরু চরাতেন বা নানা জুম চাষ করতেন। হেডম্যান যদি সে মর্মে তাকে সত্যায়ন করে তাহলে তা বাতিল হয়ে যাবে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল পুলিশ ব্যারাক, ক্যান্টনমেন্ট, ভূমি অফিস, আদালত, এমনকি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন অফিস সব বাতিল হয়ে যাবে।

পার্বত্য বাঙালি অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত বাঙালী পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন ভুইয়া বলেন, আমরা শুধু বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছি না, একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অখ-তা ও সরকারের কর্তৃত্ব, অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করছি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কাজ হবে বেদখল জমি ফেরত দেয়া। নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি করা নয়। এতোদিনে যে ভূমির স্যাটল হয়ে গেছে সেগুলো নিয়ে করবে না, বরং যেগুলো নিয়ে বিরোধ কাছে সেগুলো নিয়েই কাজ করবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, ভূমি কমিশনের কাজ নিয়ে কারো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যেসব ভূমি নিয়ে বিরোধ আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করা হবে। এখান থেকে কাউকে চলে যেতে হবে না। জমি হস্তান্তরে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা সমস্যায় পড়লে আমরা বসে থাকবো না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন